ইয়েমেনের হুথি আনসার-আল্লাহর নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী ইসরায়েলের তেলআবিব শহরের একটি সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। দেশীয়ভাবে তৈরি ‘ইয়াফা’ ড্রোন ব্যবহার করে এই হামলা চালানো হয়। তাছাড়া, ইয়েমেনের সাদা গভর্নরেটে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘জায়ান্ট শার্ক এফ-থ্রি-সিক্সটি’ গোয়েন্দা ড্রোন ভূপাতিত করেছেন তারা। শুক্রবার এক বিবৃতিতে ইয়েমেনের সশস্ত্র বাহিনী জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে চলমান ইসরায়েলি গণহত্যার জবাবে তেলআবিবে হামলা চালানো হয়েছে। তাছাড়া, ইয়েমেনের উত্তর সাদা এলাকায় হামলার সময় মার্কিন-ইসরায়েলি শত্রুদের পরিচালনা করা একটি জায়ান্ট শার্ক এফ-থ্রি-সিক্সটি ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে ইয়েমেনের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।
বিবৃতিতে বলা হয়, দেশীয়ভাবে তৈরি একটি সারফেস টু এয়ার মিসাইল ব্যবহার করে ড্রোনটিকে ভূপাতিত করা হয়। বিবৃতিতে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বের মুক্তিকামী সব মানুষকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে সতর্ক করে বলা হয়, এই নিষ্ক্রিয়তার কারণে অন্য আরব ও ইসলামি দেশগুলোতেও হামলা চালাতে পারে ইসরায়েল। এতে বলা হয়, ‘এই নীরবতা, নিষ্ক্রিয়তা এবং ধর্মীয়, নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিণতি সবার জন্য ভয়াবহ হবে।’ গাজায় হামলা বন্ধ এবং উপত্যকাটির ওপর থেকে ইসরায়েলি অবরোধ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের হামলা চলবে বলে বিবৃতিতে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়।
এদিকে, লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়েছে ইয়েমেনের সশস্ত্র বাহিনী। হামলার শিকার হয়েছে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস হ্যারি এস ট্রুম্যান-ও। এর মাধ্যমে দরিদ্র দেশটির ওপর মার্কিন হামলার দুটি পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়েছেন তারা। শুক্রবার এক বিবৃতিতে বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি বলেন, ইয়েমেনে মার্কিন হামলার জবাবে বেশ কিছু ক্রুজ মিসাইল ও ড্রোন ব্যবহার করে ইউএসএস হ্যারি ট্রুম্যান-সহ লোহিত সাগরে অবস্থান করা শত্রুদের যুদ্ধজাহাজগুলোতে হামলা চালিয়েছে তাদের বাহিনী।
তিনি উল্লেখ করেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরিচালিত এই দ্বিতীয় অভিযানে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে মার্কিন বিমান হামলার দুটি পরিকল্পনা নস্যাৎ করা হয়। বিবৃতিতে সারি জানান, সম্ভাব্য উত্তেজনা মোকাবিলায় ইয়েমেন সব ধরনের প্রস্তুতি হাতে নিয়েছে এবং গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলি ও মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে হামলা চালাবেন তারা। মুখপাত্র বলেন, ‘আগ্রাসীরা বুঝতে পারবে, মহান ইয়েমেনকে ভেঙে ফেলা যাবে না, কিংবা ইয়েমেন কখনও আত্মসমর্পণ করবে না। ফলাফল যা-ই দাঁড়াক, ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি ধর্মীয়, নৈতিক ও মানবিক কর্তব্য থেকে তারা কখনও সরে দাঁড়াবেন না।’ সারি জোর দিয়ে বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ, ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনের বিজয় হবেই।’
আনসার-আল্লাহ আন্দোলনের নেতা আবদুল মালিক আল-হুথি বলেছেন, ইয়েমেনের বিরুদ্ধে মার্কিন আগ্রাসন গাজার জনগণের সমর্থনে ইয়েমেনি অভিযানগুলো বন্ধ করতে এবং লোহিত সাগরে ইসরায়েলি জাহাজগুলোকে রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। শুক্রবার এক ভাষণে তিনি বলেন, গাজাযুদ্ধে ইসরায়েলি গণহত্যাকে সমর্থনের অংশ হিসেবে ইয়েমেনে হামলা তীব্র করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কয়েকদিনের মধ্যে ৯০ বারেরও বেশি হামলা চালিয়েছে তারা। আল-হুথি জোর দিয়ে বলেন, আগ্রাসন চালিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের সমর্থনে ইয়েমেনের অভিযানগুলোকে বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। লোহিত সাগর, এডেন উপসাগর ও আরব সাগরে ইসরায়েলি নৌযানের সুরক্ষাও দিতে পারেনি ওয়াশিংটন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, মার্কিন হামলায় ইয়েমেনের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। আল-হুথি বলেন, ইয়েমেনের নেতাদের এবং ইয়েমেনি জনগণকে নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি; হবেও না।
এদিকে, এক জরিপে দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ ইসরায়েলি অবৈধ দেশটিতে ‘গৃহযুদ্ধের শঙ্কা’-র সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। ইসরায়েলের চ্যানেল সেভেন এই জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। এর আগে ইসরায়েলে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কার সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন ইসরায়েলি সুপ্রিমকোর্টের সাবেক প্রেসিডেন্ট আহারন বারাক। এর প্রেক্ষিতে জুইশ পিপল পলিসি ইনস্টিটিউট বা জেপিপিআই এই জরিপ পরিচালনা করে।
জরিপে দেখা গেছে, ২৭ শতাংশ ইসরায়েলি আহারন বারাকের সতর্কবার্তার সঙ্গে একমত হয়ে বলেছেন, ‘তার সতর্কবার্তা যথার্থ’। অন্যদিকে ৩৩ শতাংশ মনে করেন, আহারন বারাকের মন্তব্য কিছুটা অতিরঞ্জিত হলেও গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে ২১ শতাংশ ইসরায়েলি মনে করেন, বারাক ‘খুব বেশি অতিরঞ্জিত’ তথ্য দিয়েছেন এবং গৃহযুদ্ধ আসন্ন নয়। কেবল ১৬ শতাংশ মনে করেছেন, ইসরায়েলে গৃহযুদ্ধের কোনো আশঙ্কা নেই। জেপিপিআই-এর পরিচালক ড. শুকি ফ্রাইডম্যান মন্তব্য করেছেন, ‘পাসওভারের সময় যখন ঐক্যের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তখন জরিপের এই ফল প্রমাণ করে যে, ইসরায়েলিরা বিভিন্ন ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন এবং সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ নিয়ে তারা শঙ্কিত।’
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের বরাতে জাতিসংঘের ত্রাণ ও শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা আনরোয়া জানিয়েছে, গত ১৮ মার্চ থেকে ইসরায়েল নতুন করে হামলা জোরদারের পর গাজায় প্রতিদিন নিহত বা আহত হচ্ছে অন্তত ১০০ শিশু। আনরোয়া প্রধান ফিলিপ লাজ্জারিনি এক্স পোস্টে বলেন, ‘যুদ্ধ গাজার শৈশব কেড়ে নিচ্ছে। গাজাকে শিশুদের জন্য বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে।’
লাজ্জারিনি বলেন, ‘এটি আমাদের সাধারণ মানবতার ওপর কলঙ্ক লেপন করেছে। শিশুরা যে স্থানেই থাকুক না কেন, তাদের হত্যাকে কোনোভাবে সমর্থন করা যায় না।’ দেড় বছর ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনে গাজায় ১৫ হাজারের বেশি শিশু নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৮৬ জন ফিলিস্তিনি। এছাড়া আহত হয়েছেন অন্তত ২৮৭ জন। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। গত দেড় বছরে উপত্যকায় নিহত হয়েছেন ৫০ হাজার ৬০০ জন ফিলিস্তিনি। আহত ১ লাখ ১৫ হাজারের বেশি। নিহত এবং আহতদের অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু।