ফিলিস্তিনের গাজায় নির্বিচার ও নৃশংস হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এতে নারী-শিশুসহ গাজায় হাজার হাজার নিরাপরাধ মানুষ মরছে। নৃশংস হামলার প্রতিবাদে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়েছে। গতকাল সোমবার ঢাকা, রাজশাহী, নওগাঁ ও সিলেটে সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। এতে ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং ইসরায়েল বিপক্ষে বিভিন্ন স্লোগান দেন তারা। হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা আর মাথায় কালেমা লেখা ব্যান্ড পরে ‘নো ওয়ার্ক, নো স্কুল’ এবং স্টপস ফর গাজা প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদ করা হয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে ইসরায়েলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়েছে। গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদের ভাষা ফুটিয়ে তোলা হয় শিক্ষার্থীদের প্ল্যাকার্ডে। ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের নির্মম হামলার প্রতিবাদ ও গাজাবাসীর ডাকা হরতালের সমর্থনে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় ওই এলাকার চারদিকে বিক্ষোভকারীদের ঢল নেমেছে। সংসদ ভবনের সামনে বিক্ষোভকারীদের হাতে বিভিন্ন ফটোকার্ড ও ব্যানার নিয়ে মিছিল নিয়ে সমবেত হয়েছেন শত শত মানুষ। ‘সেভ গাজা’, ‘স্টপ জেনোসাইড টু গাজা’ লেখা প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার নিয়ে বিক্ষোভকারীরা মিছিলে অংশ নেন।
তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থী ও নানা পেশাজীবী মানুষ একে একে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াতে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে সমবেত হোন। ঘণ্টাব্যাপী সমাবেশ শেষে বিকাল ৫টার দিকে একটি প্রতিবাদী মিছিল বের করে মানিক এভিনিউ সড়কে প্রদক্ষিণ করে। ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াতে মুসলমান নয়, হতে হবে মানুষ, আমার ভাই মরলো কেনও জবাব চাই, লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে, বীর বাঙালি জেগেছে, ট্রাম্পের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, ফিলিস্তিনি মুক্ত করো, এমন নানান স্লোগানে মুখর হয়েছিল পুরো প্রাঙ্গণ।
বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করা একজন প্রকৌশলী সামছুজ্জামান বাবুল বলেন, আজকে আমরা এসেছি এটি আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। আমাদের এখানে থেকে দাবি তুলতে চাই। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাপী তিনি একজন কূটনৈতিক কৌশলী। বাংলাদেশের ১৮ কোটির প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের একটাই দাবি, এই যুদ্ধ বন্ধ করতে আমাদের রাষ্ট্র প্রধানকে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে রক্তকরণ হচ্ছে, সবার ঘর থেকে বের হতে হবে। যার যার জায়গা থেকে এ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিক্ষোভকারীরা বলেন, পৃথিবীর সব ধরনের নিপীড়িত মানুষের কান্না এক। আমরা নেতানিয়াহুর রক্তপিপাসু বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছি। বাংলাদের তরুণদের মতো সারা বিশ্বে ফিলিস্তিনের পক্ষে একই শব্দ উচ্চারণ হোক।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে এসব মিছিল শুরু হয়। বেলা পৌনে ২টায় মার্কিন দূতাবাসের উল্টো দিকের পদচারী সেতুর সামনে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সটির একদল শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করছিলেন। তারা গাজায় ইসরায়েলের নারকীয় হামলার বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানান। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ‘ফ্রি ফ্রি ফিলিস্তিন’, ‘ট্রাম্পের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে’, ‘আমরা কারা, তোমরা কারা ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন’ বলে স্লোগান দেন। গুলশানে মার্কিন দূতাবাস এলাকায় মিছিল বের করেন একদল তরুণ। মার্কিন দূতাবাসের সামনে সড়কে অবস্থান নেন তারা। এ সময় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন বেসরকারি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ), ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (আইইউবি), আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি) ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভকে ঘিরে দূতাবাস এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। নিরাপত্তা নিশ্চিতে এলাকাটিতে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন সেনাবাহিনী, বিজিবি, এপিবিএন, এসবি, সিআইডি, পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা। এ ছাড়া নিরাপত্তা জোরদার করা হয় গুলশান এলাকায় থাকা অন্য দূতাবাসগুলোতেও।
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুর রহমান বলেন, সকাল ১০টার দিক থেকে ভাটারা থানা এলাকায় বিক্ষোভ শুরু হয়। তখনো বিক্ষোভ চলছিল। ছোট ছোট দলে বিক্ষোভকারীরা এসে বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভ করে চলে গেছেন।
নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়ে পুলিশের গুলশান জোনের এসি আলী আহমেদ মাসুদ বলেন, ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন অনেকে। সে জন্য এখানে দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিজিবি, সিআইডি, এসবি, গোয়েন্দা সংস্থা এবং ডিপ্লোমেটিক জোনের নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের সঙ্গে কাজ করেছেন।
রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ চলাকালে সরকারি বিজ্ঞান কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রাফিউল আজম সিফাত বলে, ‘গাজায় এমন নির্মম গণহত্যার দৃশ্য দেখার পর থেকে আর সুস্থির থাকতে পারছি না। আজকে বিশ্বব্যাপী কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আমরা আমাদের ক্লাস বাতিল করেছি। আমরা ফিলিস্তিনি মানুষের মুক্তি চাই। স্বাধীন ফিলিস্তিন চাই।’ সমাবেশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রেজাউল করিম বলেন, ‘একটা জাতির ওপর এভাবে দিনের পর দিন হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ ও সংগঠনের কোনো টনক নড়ছে না। কাজেই আমাদের জায়গা থেকে যা যা করা সম্ভব আমরা করব।’
ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর হামলার প্রতিবাদে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। বাড্ডা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় গেটের সামনে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে আমি কে, প্যালেস্টাইন প্যালেস্টাইন’, ‘ট্রাম্পের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে’, ‘নেতানিয়াহুর দুই গালে জুতা মারো তালে তালে’, ‘ইসরায়েলের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
এছাড়াও নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেছেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন। চাঁদপুর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তাকর্মচারী, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, পিরোজপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পিবিপ্রবি) শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং নওগাঁ শহরের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ অন্তত ১০টি সংগঠন বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে।
জামায়াতে ইসলামী : অবিলম্বে গাজায় নারী-শিশু হত্যাসহ ন্যক্কারজনক হামলা বন্ধ করতে হবে। যদি না করা হয়, তাহলে বিশ্ব মুসলিম গাজার দিকে মার্চ করতে বাধ্য হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলিম উম্মাহ ইসরায়েলকে বিশ্ব মানচিত্র থেকে গুঁড়িয়ে দেবে। রাজধানীতে এক বিক্ষোভ মিছিল শেষে এসব কথা বলেন ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ড. রেজাউল করিম। তিনি বলেন, সারা পৃথিবীর কাছে কুখ্যাত সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে খ্যাত ইসরায়েল ফিলিস্তিনের গাজাবাসী নারী ও শিশুকে হত্যা করে আইয়ামে জাহেলিয়াতের বর্বর যুগের ইতিহাসকে হার মানিয়েছে। ইসরায়েল গণহত্যা পরিচালনার মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। এই সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলমানদের গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তিনি বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা শুধু ইসরায়েলি পণ্য বয়কট করতে চাই না। পৃথিবীর বুকে যেখানেই ইহুদি থাকবে সেখানেই তাদের বয়কট করা হবে। তরুণ যুবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ছাত্রশিবিরের সাবেক এই কেন্দ্রীয় সভাপতি বলেন, জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ হয়ে তৈরি হওয়ার মাধ্যমে ইসরায়েলকে বয়কট করে গাজাবাসীর পাশে দাঁড়াতে হবে। সন্ত্রাসী ইসরায়েলের কালো থাবা থেকে তাদের মুক্ত করতে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দক্ষতার মাধ্যমে চূড়ান্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
তিনি জাতিসংঘ ও ওআইসিকে বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলকে বয়কট এবং জেনোসাইডের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। ইন্ধনদাতাণ্ডসমর্থন দেওয়া রাষ্ট্রগুলোকে হুঁশিয়ারি দিয়ে এ জামায়াত নেতা বলেন, অবিলম্বে গাজায় গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, হামলা বন্ধ করুন। যদি তা করা না হয়, তাহলে গোটা মুসলিম উম্মাহ দুর্বার বৈশ্বিক আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হবে। বিক্ষোভ মিছিলে জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মুসল্লিরা অংশ নেন। সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।
জাতীয় নাগরিক পার্টি : জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর গণহত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। ফিলিস্তিনে গণহত্যা চলছে; ভারতে, কাশ্মীরে, রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। এসব নির্যাতন বিশ্বের মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বার্তা দেয়। রাজধানীর শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে আয়োজিত ‘ফিলিস্তিনে ইসরাইলের গণহত্যা ও ভারতের ওয়াকফ বিল সংশোধনের’ দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি এমন মন্তব্য করেন। আখতার হোসেন বলেন, পৃথিবীর সব প্রান্তের মুসলিমদের উপর নির্যাতন তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বার্তা দেয়। আমরা মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাই।
কিছুদিন আগে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, আমরা জানি স্বাধীনতার মূল্য কত। আমরা প্রত্যাশা করি ফিলিস্তিনের মানুষ খুব শিগগিরই স্বাধীনতার স্বাদ পাবে। জাতিসংঘের কাছে আহ্বান জানাব অবিলম্বে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। যুদ্ধবিরতি চলাকালীন হামলাকারী নেতানিয়াহুসহ যারা যুদ্ধপরাধ করেছে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিশ্বের যেখানেই ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মুক্তি দেয়া এবং অতিদ্রুত ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানাই।