নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই তহবিল থেকে স্টার্ট-আপ কোম্পানিগুলোকে মূলধন জোগান দেবে। গতকাল সোমবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত চারদিনব্যাপী বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫-এর স্টার্ট-আপ কানেক্ট সেশনের আলোচনায় এ কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
কয়েক মাস আগে বিডার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ উদ্যোগ নেয়। মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংকের অংশগ্রহণে, তারাই হবেন সেই ইক্যুইটির মালিক। এই অর্থ কেবল সম্ভাবনাময় স্টার্টআপের জন্য ইক্যুইটি বিনিয়োগ হিসাবে ব্যবহার হবে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে সেই তহবিল চালু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, আমি মনে করেছিলাম, এ সময়ের মধ্যে এটা চালু হয়ে যাবে। কিন্তু আমি লন্ডনে থাকায় এবং ঈদ ছুটির কারণে এটা এখনও হয়নি, আমরা এক মাসের মত হারিয়েছি। এটা এক সপ্তাহ সময়ে প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার কথা; আমরা সার্কুলার জারি করে দেব। ইক্যুইটির বাইরে স্টার্টআপগুলোকে ঋণ হিসাবে দেওয়ার জন্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আরেকটি তহবিল গঠনের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে গভর্নর বলেন, যাতে কেউ চাইলে ইক্যুইটি পায়, কিংবা ঋণ হিসাবেও তহবিল পায়। এটা কেবল শুরু, এটা শেষ হয়। স্টার্টআপ সেক্টর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই তহবিলের আকারও ধীরে ধীরে বাড়বে। এই প্রতিশ্রুতি আমরা দিচ্ছি।
বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণে পিছিয়ে আছে, সে কথা তুলে ধরে গভর্নর বড় আকারে একটি সমীক্ষা চালানোর কথা বলেন, যেখানে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সম্ভাবনা ও তহবিলের প্রয়োজনীয়তার বিষয়গুলো দেখা হবে। এসব তহবিল গঠনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে আমি চেষ্টা করছি, এই উদ্ভাবনী মননকে কীভাবে সহযোগিতা দেয়া যায়, যাতে তারা বিকশিত হতে পারে। আমাদের দরকার তাদের জন্য পরিবেশটা তৈরি করা এবং উদ্ভাবনের জন্য বাংলাদেশকে তাদের কাছে আকর্ষণীয় করা। যাতে তারা উদ্যোগটা নিয়ে চলে না যায়, বরং বাংলাদেশে নিয়ে আসে এবং দেশের ভেতরে এটাকে বড় করে।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী বাস্তবতায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে বিডা আয়োজনে চারদিনের এই বিনিয়োগ সম্মেলন শুরু হয়েছে। গতকাল সম্মেলনের প্রথম দিনে চট্টগ্রামে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শনের গেছেন প্রায় ৬০ জন বিনিয়োগকারী; আর ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে হয়েছে উচ্চণ্ডপর্যায়ের প্লেনারি অধিবেশন। গতকাল সকালের প্লেনারি সেশন ‘বাংলাদেশ স্টার্টআপ কানেক্ট’-এ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কনস্টেলেশন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির চেয়ারম্যান তানভীর আলী। শেয়ারট্রিপের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া হকের সঞ্চালনায় ওই আলোচনা পর্বে প্রধান উপদেষ্টার তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, অর্থ সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বক্তব্য দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, দেশের ৪৭ শতাংশ মানুষ কোনো ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রমের মধ্যে নেই। দেশের ৬ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে আর্থিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে নতুন ফিনটেক প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ২০৩০ সাল না হলেও, ২০৩৫ সালের মধ্যে আমরা ট্রিলিয়ন ডলারের ইকোনমিতে পৌঁছাবো। ৪৭ শতাংশ ব্যাংকিং কার্যক্রমে নেই। ফিনটেক উদ্যোক্তাদের এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। আমরা উদ্যোক্তাদের সহযোগী হয়ে কাজ করতে চাই। বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের সহযোগিতা করবে। মন খুলে কথা বলুন, দ্রুত আপনাদের সমস্যার সমাধান হবে। ২০১৯ সালে যখন শুরু করি তখন অথৈ সাগরে পড়ে যাই। কোথা থেকে কী শুরু করবো বুঝতে পারছিলামনা। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নানান আইন ও বিধি আছে। নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, পণ্যের প্রতি যত্মশীল হতে হবে। কাজ শুরু করুন। লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক সময় সাপেক্ষ।
আয়োজকরা বলেন, পরিবর্তনশীল বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে রূপান্তরিত সময়ের সুযোগ এবং অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কাজে লাগানোর উপর আলো ফেলাই এই আয়োজনের উদ্দেশ্য। বুধবার সকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের স্টারলিঙ্কের স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হবে।
বাংলাদেশ শুধু বাণিজ্যের জন্য নয়, বিনিয়োগের জন্যও একটি উপযুক্ত গন্তব্য। ৯৫ শতাংশ স্টার্ট-আপই ব্যর্থ হয়, তবে আমরা নিশ্চিত যে সরকার তাদের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে এবং একদিন তারা সফলতা অর্জন করবে। স্টার্ট-আপ কোম্পানির জন্য যে তহবিলটি গঠিত হবে এটি শুধু নতুন উদ্যোক্তাদের মূলধন সহায়তার জন্য নির্ধারিত হবে এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা হবে বলেও জানান তিনি। অনুষ্ঠানে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব বলেন, সরকার দেশের ইন্টারনেট সেবার মান উন্নত করার জন্য কাজ করছে। সাবমেরিন ক্যাবলের ব্যান্ডউইথের দাম ইতোমধ্যে ১০ শতাংশ কমানো হয়েছে এবং মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতাদের নীতি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা উন্নত সেবা প্রদান করতে পারে।
চট্টগ্রাম কেইপিজেড পরিদর্শন করলেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা : বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) আয়োজনে চার দিনব্যাপী ‘বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫’ শুরু হয়েছে। একদল বিদেশি বিনিয়োগকারী বিশেষ ফ্লাইটে চট্টগ্রামে যান। সেখানে তারা কেইপিজেড পরিদর্শন করেন। এবারের সম্মেলনে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে সম্ভাবনাময় মোট পাঁচটি সেক্টরে (নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, ফার্মাসিটিক্যাল, ডিজিটাল ইকোনমি এবং টেক্সটাইল) বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরে উৎসাহিত করা হয়। মঙ্গলবার বিনিয়োগকারীদের নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে (যেখানে জাপানি ইকোনমিক জোন রয়েছে) সরেজমিন পরিদর্শন করে সেখানকার ফ্যাক্টরির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে কী ধরনের কর্মকাণ্ড হচ্ছে তা বুঝে তাদের বিনিয়োগের জন্য কতটুকু সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা দেখবেন। দ্বিতীয় ধাপে বিশ্বব্যাংক ও আইএলওর সাথে কিছু এঙ্গেজমেন্ট আছে। তারা এফডিআই রিলেটেড কিছু ব্যাপারে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিনিয়োগের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায়, সে ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।