ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা, মিলেছে আশাও

* বিনিয়োগের এত অনুকূল পরিবেশ কখনও ছিল না : ড. ইউনূস * নাসার সঙ্গে চুক্তি করল বাংলাদেশ * নারায়ণগঞ্জে কারখানা করবে সুইডিশ কোম্পানি
বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা, মিলেছে আশাও

রাজধানী ঢাকায় চার দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন চলছে। এই সম্মেলন ঘিরে বিদেশি বিনিয়োগকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসছে। এসব বিনিয়োগকারী যাতে দেশের বাজারে বিনিয়োগ করে, সেই চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। কারণ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করতে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েক ডজন বিনিয়োগকারী এবং ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূত নিনা পি. কেইনগ্লেট। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রবর্তিত বিনিয়োগ পরিবেশ, বাণিজ্য ও শ্রম সম্পর্কিত সংস্কার বাংলাদেশে আরও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে এবং চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার আরও উৎপাদন কারখানা দেশে স্থানান্তর সহজতর করবে। তিনি বলেন, গত আট মাসে আমাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে বিনিয়োগ সহজ করা। দেশে-বিদেশি বিনিয়োগের এমন অনুকূল পরিবেশ আগে কখনও ছিল না।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান প্রতি মাসের ১০ তারিখে কোরিয়ান ও চীনা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে মাসিক প্রাতরাশ বৈঠকের আয়োজন করবেন। বিডার আয়োজনে এসব বৈঠক হলেও প্রধান উপদেষ্টা বিনিয়োগকারীদের উত্থাপিত বিভিন্ন বিষয় শোনার জন্য সেগুলোর কয়েকটিতে অংশ নেবেন। প্রধান উপদেষ্টা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি হটলাইন ও কল সেন্টার সার্ভিস স্থাপনের প্রস্তাব করেন, যাতে তারা দ্রুত অভিযোগ দায়ের করতে পারে। তিনি বলেন, যে কোনো বিনিয়োগকারী এই নম্বরে কল করে তাদের অভিযোগ নথিভুক্ত করতে পারবেন এবং আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, পরিবহন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, টেক্সটাইল, মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, লজিস্টিকস এবং আইটি পরিষেবার মতো খাতের বড় বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী কমপক্ষে ৩০ জন বিশিষ্ট চীনা বিনিয়োগকারী এই বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান মেইনল্যান্ড হেডগিয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট পলিন এনগান। প্রফেসর ইউনূস সম্প্রতি বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরেন, সেখানে প্রেসিডেন্ট শি চীনের শীর্ষ কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার বিষয়ে তার প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। প্রধান উপদেষ্টা প্রেসিডেন্ট শি সম্পর্কে বলেন, তার আচরণে আমি অভিভূত হয়েছি। চীনা কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা চট্টগ্রামে চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মোংলায় পরিকল্পিত চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল উভয় ক্ষেত্রেই বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, যেখানে চীন একটি সমুদ্রবন্দর আধুনিকায়ন করতে প্রস্তুত। বাংলাদেশকে একটি শীর্ষ বৈশ্বিক উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তরের প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেশ কয়েকটি কোম্পানি বাংলাদেশকে তাদের দক্ষিণ এশিয়ার উৎপাদন ও অপারেশন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, আমাদের এখানে একেবারেই প্রস্তুত একটি বাজার রয়েছে এবং এর পাশাপাশি আপনি নেপাল ও ভুটানের মতো স্থলবেষ্টিত দেশগুলোতেও পণ্য সরবরাহ করতে পারেন। কিছু বৃহত্তর চীনা প্রতিষ্ঠান বৈদ্যুতিক যানবাহন (ইভি) রূপান্তর, লিথিয়ামণ্ডআয়ন ব্যাটারি উৎপাদন, বায়ু বিদ্যুৎ এবং অফশোর ফটোভোলটাইক সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

এর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েক ডজন বিনিয়োগকারীও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন। কোরিয়ান এ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন ইয়াংওয়ান কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাং। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীদের বৈঠকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এ তথ্য জানান।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের আয়োজনে চার দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রতিনিধি দলটির এ বৈঠক হয়। বৈঠকে বিডার চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন ও এসডিজি সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।

নাসার সঙ্গে চুক্তি করল বাংলাদেশ: ৫৪তম দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সঙ্গে ‘আর্টেমিস অ্যাকর্ডস’-এ স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এই চুক্তির মাধ্যমে মহাকাশ গবেষণায় সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বিনিয়োগ সম্মেলন নিয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। এসময় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস স?চিব শ?ফিকুল আলম।

তিনি বলেন, ‘আর্টেমিস অ্যাকর্ডস’-এ স্বাক্ষরকারী ৫৪তম দেশ বাংলাদেশ। এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ তার মহাকাশ গবেষণা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হবে। তবে এর সুফল হয়তো এখনই পাওয়া যাবে না, ২০ থেকে ২৫ বছর সময় লেগে যাবে। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান ও ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের উপস্থিতিতে প্রতিরক্ষা সচিব মো. আশরাফ উদ্দিন এ চুক্তিতে সই করেন। এ উদ্যোগের মাধ্যমে বৈশ্বিক মহাকাশ গবেষণা, মহাকাশ ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও মহাকাশ সম্পদের দায়িত্বশীল ব্যবহারে যুক্ত হলো বাংলাদেশ। অনুষ্ঠানে চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, চুক্তিটি সইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মহাকাশ গবেষণায় সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার মহাকাশ গবেষণা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হবে। প্রতিরক্ষা সচিব আশরাফ উদ্দিন বলেন, আর্টেমিস চুক্তি মূলত আউটার স্পেস ট্রিটি রেজিস্ট্রেশন কনভেনশন ও অ্যাস্ট্রোনট রেসকিউ অ্যাগ্রিমেন্টের নীতিগুলো অনুসরণ করে তৈরি একটি নির্দেশিকা, যা মহাকাশের শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও টেকসই ব্যবহারে সহায়ক। তিনি বলেন, মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার জন্য ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো) প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর থেকে বাংলাদেশ মহাকাশের শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের আন্তর্জাতিক নিয়মণ্ডনীতি অনুসরণ করছে। চুক্তি সই করা দেশগুলো মহাকাশে স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল কার্যক্রম পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দেয়। চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫৩টি দেশ এ চুক্তিতে সই করেছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া। এছাড়া, ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশ এ চুক্তিতে সই করেছে।

চুক্তিটিতে সইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক মহাকাশ জোটের অংশীদার হবে বলে উল্লেখ করেন আশরাফ উদ্দিন। তিনি বলেন, এ চুক্তির ফলে প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক এবং বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে। চুক্তিটি স্পারসো ও নাসার মধ্যে সহযোগিতার পথ উন্মোচিত করবে এবং মহাকাশ অভিযানকে আরও এগিয়ে নিতে স্পারসোর বর্তমান সক্ষমতাকে আরও বৃদ্ধি করবে।

নারায়ণগঞ্জে কারখানা করবে সুইডিশ কোম্পানি: নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ স্পেশাল ইকোনমিক জোনে (বিএসইজেড) কারখানা স্থাপন করতে যাচ্ছে সুইডিশ কোম্পানি নিলোর্ন বাংলাদেশ লিমিটেড। সে লক্ষ্যে গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনীতি অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারো কাওয়াচির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছেন নিলোর্ন বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল কাইয়ুম। মূলত, নিলোর্ন পোশাক ও অন্যান্য পণ্যের লেভেলিং ও ব্র্যান্ডিং সল্যুশন দিয়ে থাকে। নতুন এ কারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে কোম্পানিটির বিনিয়োগ আরও সম্প্রসারিত হবে বলে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এর আগে, এদিন সকালে বিএসইজেড পরিদর্শন করেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এসময় তাদের জাপানের সহায়তায় গড়ে ওঠা এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামো, সম্ভাবনা ও চলমান প্রকল্প সম্পর্কে জানানো হয়ে। পরিদর্শনকালে প্রতিনিধিরা সরকারের বিনিয়োগবান্ধব উদ্যোগের প্রশংসা করেন এবং ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিএসইজেড জাপান ইকোনমিক জোন নামেও পরিচিত। যা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)-এর যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সফরের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সরাসরি মাঠ পর্যায়ে সম্ভাবনা পরখ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর আগে গত সোমবার বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রথম দিনে ৭০ জন বিনিয়োগকারীর একটি প্রতিনিধি দল চট্টগ্রামের মিরেরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত