বাংলাদেশকে দেয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ভারত সরকার। গত সোমবার জারি করা ভারতের কেন্দ্রীয় পরোক্ষ কর ও শুল্ক বোর্ডের (সিবিআইসি) এক সার্কুলারে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এই সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য ভারতের স্থল বন্দর ব্যবহার করতে পারতো। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের ভূমিবেষ্টিত প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) অভিযোগ জানানো সম্ভব।
কী করতে পারে বাংলাদেশ : ভারত নিয়ম লঙ্ঘন করলে বাংলাদেশের পক্ষে ডব্লিউটিওতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করার অধিকার রয়েছে। ডব্লিউটিওর বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রথমে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার চেষ্টা করতে পারে। যদি তাতে সমাধান না হয়, তবে বাংলাদেশ বিষয়টি ডব্লিউটিওর বিরোধ নিষ্পত্তি সংস্থা (ডিএসবি)-এর কাছে উত্থাপন করতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রমাণ করতে হবে, ভারত সুনির্দিষ্টভাবে ডব্লিউটিওর নিয়ম ভঙ্গ করেছে এবং বাধার ধরনটি অযৌক্তিক বা বৈষম্যমূলক। উদাহরণস্বরূপ, ভারত যদি নিরাপত্তার কারণে বা যুক্তিসঙ্গত প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার জন্য বাধা দেয়, তবে তা ডব্লিউটিওর নিয়মের আওতায় বৈধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু যদি বাধাটি অযৌক্তিক বা বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী হয়, তাহলে বাংলাদেশের অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে।
কেন এই সিদ্ধান্ত : বিশেষত গার্মেন্টস খাতের ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা দীর্ঘদিন ধরেই এই সুবিধা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তারা অভিযোগ করছিলেন, প্রতিদিন প্রায় ২০-৩০টি ট্রাক বাংলাদেশ থেকে দিল্লি বিমানবন্দর কার্গো টার্মিনালে প্রবেশ করে, যার ফলে ভারতীয় পণ্যের রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। বিমান সংস্থাগুলো অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে ও কার্গো প্রক্রিয়ায় দেরি হচ্ছে, যার ফলে ভারতীয় পণ্যের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ভারতের অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রমোশোন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সুধীর সেখরি বলেন, দিল্লির কার্গো টার্মিনালে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশে জটলা তৈরি হচ্ছে। এর ফলে প্লেন ভাড়ার হার বেড়েছে, রপ্তানি পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণে বিলম্ব হচ্ছে ও ভারতীয় রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ভারতীয় বিশ্লেষকদের দাবি, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধাক্কা। গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি-আমদানি ব্যবস্থাপনা অনেকাংশে ভারতীয় অবকাঠামোর উপর নির্ভর করে। ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ হলে, বাংলাদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়ায় দেরি, খরচ বৃদ্ধি ও অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। তিনি আরও বলেন, এই সিদ্ধান্ত নেপাল ও ভুটানের জন্যও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, কারণ দুটি দেশই ভূমিবেষ্টিত ও তারা বাংলাদেশে পণ্য পাঠাতে ভারতীয় রুট ব্যবহার করে। এর ফলে, এই দুই দেশও ভারতের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে। শ্রীবাস্তব আরও জানান, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, সদস্য দেশগুলোকে ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোর জন্য স্বাধীন ট্রানজিট সুবিধা দিতে হয়। অর্থাৎ, তাদের পণ্য অবাধে গন্তব্যে যেতে দিতে হবে, যাতে অপ্রয়োজনীয় দেরি, শুল্ক বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করা হয়। ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি অনুযায়ী প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করতে পারে। আবার ভারতীয় রপ্তানিকারকদের জন্য তাৎক্ষণিক সুবিধা হলেও দীর্ঘমেয়াদে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও পরিবহন ব্যবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ভারতীয় রপ্তানিকারকরা, বিশেষ করে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে এই সুবিধা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনস (এফআইইও) মহাপরিচালক অজয় সাহাই বলেন, এর ফলে আমাদের পণ্যের জন্য প্লেনে বেশি জায়গা পাওয়া যাবে। আগে বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্টের কারণে জায়গার অভাবে ভুগতে হতো। এই সিদ্ধান্ত পোশাক, জুতা এবং রত্ন ও জহরত খাতে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের সুবিধা দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রে ভারতের বড় প্রতিযোগী। ভারতের অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের (এইপিসি) চেয়ারম্যান সুধীর শেখরি জানান, বাংলাদেশের পণ্যবাহী ২০-৩০টি ট্রাক প্রতিদিন দিল্লি এয়ার কার্গো কমপ্লেক্সে আসতো, যা পণ্য চলাচলে বিলম্ব, প্লেন ভাড়া বৃদ্ধি এবং কার্গো টার্মিনালে ভিড়ের কারণ হতো। এটি ভারতীয় পোশাক রপ্তানিকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিচ্ছিল।
বড় ধাক্কা বাংলাদেশের জন্য : কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বাণিজ্যে বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই) প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, এটি বাংলাদেশের রপ্তানি ও আমদানি লজিস্টিকসে ব্যাঘাত ঘটাবে, যা তৃতীয় দেশের বাণিজ্যে ভারতীয় অবকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল। এর আগে এই ব্যবস্থা সময় ও খরচ কমিয়েছিল। এখন বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের বিলম্ব, বাড়তি খরচ এবং অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হবে। তিনি আরও বলেন, নেপাল ও ভুটান দুটি ভূমিবেষ্টিত দেশ, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যে সীমিত ট্রানজিট সুবিধা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে। ডব্লিউটিওর নিয়ম অনুযায়ী, সদস্য দেশগুলোকে ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোর পণ্যের জন্য অবাধ ট্রানজিট নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব বা শুল্ক না থাকে।