ঢাকা রোববার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে ‘সমস্যা নেই’ বাংলাদেশের

* ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে কোনো সমস্যা বোধ করছি না : বাণিজ্য উপদেষ্টা * পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক * বেনাপোল থেকে বাংলাদেশি পণ্যবাহী ৪ ট্রাক ফেরত পাঠাল ভারত
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে ‘সমস্যা নেই’ বাংলাদেশের

ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে কোনো প্রভাব পড়েনি দেশের একমাত্র চতুর্দেশীয় স্থলবন্দর পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধায়। অন্যদিনের মতো গতকাল বৃহস্পতিবারও এই শুল্ক স্টেশন দিয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা হয়। গতকাল বিকেলে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বৃহস্পতিবার নেপাল ও ভুটান থেকে অন্যদিনের মতোই এসেছে বোল্ডার পাথর, সুগার মোলাসিস, অর্গানিক রংসহ অন্যান্য পণ্য। ৪৩টি পণ্যবাহী ট্রাকে ১ হাজার ২৪০ টন পণ্য আমদানি করা হয়।

এছাড়া বাংলাদেশ থেকে পাটের কাঁচামাল, আলু, টিস্যু পেপারসহ অন্যান্য পণ্যের ২২টি ট্রাকে ৪৮৩ টন পণ্য যায় নেপালে। স্থলবন্দর সূত্র জানায়, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে নেপালে নিয়মিত আলু রপ্তানি করা হচ্ছে। গত বুধবারও ৩১৫ মেট্রিক টন আলু নেপালে রপ্তানি করা হয়। গত দুই মাসে থিংকস টু সাপ্লাই, হুসেন এন্টারপ্রাইজ, স্বাধীন এন্টারপ্রাইজ ও ক্রসেস এগ্রো নামে চারটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এই স্থলবন্দর দিয়ে কয়েক দফায় ৩ হাজার ১৫০ মেট্রিক টন আলু রপ্তানি করে নেপালে। ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য তৃতীয় কোনো দেশে রপ্তানি হতো। ২০২০ সালের ২৯ জুন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এই চুক্তি হয়েছিল। এর মাধ্যমে ভারতের স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভুটান, নেপাল, মিয়ানমারসহ তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানি সুবিধা পেতো বাংলাদেশ। গত মঙ্গলবার সেই চুক্তি বাতিল করে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি)।

বুধবার ভারত বলেছে, যেসব পণ্যবোঝাই ট্রাক এরই মধ্যে ভারতের ভূখণ্ডে আছে, সেগুলোকে দ্রুত ভারত ত্যাগ করতে হবে। আর এ আদেশের আগে যেসব পণ্য এন্ট্রি হয়ে আছে তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা নেই। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমাদের স্থলবন্দরে আপাতত আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রয়েছে। আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত অফিসিয়ালি তেমন কোনো নির্দেশনা আসেনি। আজও আমাদের এই বন্দর দিয়ে বিভিন্ন পণ্য ভারত ও নেপালের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি হয়েছে। অন্য দিনের মতো বৃহস্পতিবারও আমরা কাজ করেছি। বন্দরের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের আমদানি রপ্তানিকারকসহ ব্যবসায়ীদের জানাতে চাই, আমাদের এখানে কোনো সমস্যা নেই। স্বাভাবিকভাবেই পণ্য আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে।

ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের সিএন্ডএফ এজেন্টস স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, স্থলবন্দর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা বন্ধের জন্য ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় একটি চিঠি ইস্যু করেছে। এ চিঠির আলোকে ট্রানজিট সুবিধার পণ্য বেনাপোল বন্দর থেকে পেট্রাপোল বন্দরে প্রবেশ বন্ধ রয়েছে।

ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে বাংলাদেশ কোনো সমস্যাবোধ করছে না বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য উপদেষ্টা এ কথা বলেন। ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য তৃতীয় দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা গত মঙ্গলবার বাতিল করেছে ভারত।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা (ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল) আমাদের ওপর হঠাৎ করে আরোপিত হয়েছে। সাথে সাথেই আমাদের সকল অংশীজন নিয়ে গতকাল আমি মিটিং করেছি। ইনশাআল্লাহ, এটাতে আমরা কোনো সমস্যাবোধ করছি না। আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা, প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় যাতে কোনো ঘাটতি না হয় এবং আমাদের রপ্তানির ক্ষেত্রে যাতে যোগাযোগের কোনো ঘাটতি না পড়ে- সেক্ষেত্রে আমরা সব ব্যবস্থা নিচ্ছি, আমি আশা করি ইনশাআল্লাহ, এটা আমরা উতরে যাব।’ কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- এ বিষয়ে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে আপনার সঙ্গে শেয়ার করবো না। প্রতিযোগিতায় আমাদের যে প্রতিবন্ধকতাগুলো আছে, সেগুলো কিছু কাঠামোগত, কিছু খরচের দিক থেকে- সব জিনিস সমন্বয় করে আমরা সক্ষমতা বৃদ্ধি করব। আমি এখানে কোনো সমস্যা দেখছি না।’

এটা নিয়ে আপনারা ভারতকে কোনো চিঠি দেবেন কি না- জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা এই মুহূর্তে বিবেচনা করছি না।’

ভারতের ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধায় কী পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়- জানতে চাইলে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টনের মতো ম্যাটেরিয়াল সড়কপথে ভারতের বিভিন্ন বন্দর বিশেষ করে দিল্লি, কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি হতো। আমরা আশা করি, এই ম্যাটেরিয়ালগুলো বহনের জন্য নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ সমস্যা অতিদ্রুত সমাধান করবো ইনশাআল্লাহ। সাধারণত ইউরোপীয় দেশগুলোতে পণ্যগুলো যেত।’

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক স্থগিতের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ ভেরি গুড। আমাদের বাণিজ্যের মধ্যে স্থিরতা দেখা দেবে।’ তিনি বলেন, ‘গতকাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসটিআরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের মিটিং হয়েছে অনলাইনে। আমরা আমাদের কর্ম সমষ্টিগুলো নিয়ে কাজ করছি। যখন সম্ভব আমরা দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রে নিজেরাও যাবো, গিয়ে আমরা আমাদের অবস্থান তুলে ধরবো।’

বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘স্থগিতাদেশ তো সাময়িক সময়ের জন্য। এ বিষয়ে আমাদের দীর্ঘমেয়াদে করণীয় আছে, তাদের আকাঙ্ক্ষা তো শেষ হয়ে যায়নি। সেই আকাঙ্ক্ষাগুলোকে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ওপর ভিত্তি করে কতটুকু করতে পারব- সেই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করছি এবং সেই অনুযায়ী আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’ তিনি বলেন, ‘মূল আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে বাণিজ্য ঘাটতি কীভাবে সমন্বয় করা। আমরা সেই পরিপ্রেক্ষিতেই কাজ করছি।’

বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান বলেন, ভারত সরকার ট্রানজিট সুবিধা বাতিল করেছে। সে কারণে বেনাপোল বন্দর দিয়ে চারটি রপ্তানি পণ্যবোঝাই ট্রাক ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে প্রবেশের জন্য গেলে তা ফেরত পাঠায়। ট্রাকগুলো ঢাকার রপ্তানিকারক ডিএসভি এয়ার অ্যান্ড সি লিমিটেডের ছিল।

বেনাপোল স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবির তরফদার বলেন, ট্রানজিট সুবিধা বাতিল করায় পেট্রাপোল কাস্টমস তৃতীয় দেশের কোনো পণ্যে কার্পাস ইস্যু করেনি। ফলে গতকাল তৃতীয় কোনো দেশে রপ্তানির জন্য যাওয়া চার ট্রাক পণ্য তারা রিসিভ করেনি।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় ভারতের ভূমি ও অবকাঠামো ব্যবহার করে কম খরচে ও কম সময়ে বাণিজ্য করার সুবিধা পেয়ে আসছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সুবিধা বাতিল করায় কয়েকটি দেশে পণ্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবেন রপ্তানিকারকরা।

বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এছাড়া ট্রাক, কাভার্ডভ্যান খাতেও ছিল একটি বড় আয়ের উৎস। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রপ্তানি পণ্য বোঝাই শত শত ট্রাকগুলো যেত বেনাপোল বন্দরে। সেখান থেকে পেট্রাপোল বন্দরে পণ্য আনলোড করে চলে আসত। এতে তারা নির্দিষ্ট একটি ভাড়া পেত। সেটাও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। এমনিতেই বাংলাদেশি পর্যটকের অভাবে মহাসংকটে রয়েছে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি। এরমধ্যে বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের ফলে শুধু পেট্রাপোল স্থলবন্দরেই ৪০ শতাংশ আর্থিক ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা।

পেট্রাপোল স্থলবন্দরের ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী জানান, বাংলাদেশ থেকে আসা কন্টেইনারগুলোতে বাংলাদেশের পোশাক এবং অন্যান্য পণ্য থাকত। এসব পণ্য ভারত হয়ে যেত তৃতীয় দেশে। পণ্যগুলো বাংলাদেশ থেকে প্রথমে পেট্রাপোল স্থলবন্দরে যেত। এরপর সেগুলো কাস্টমস সিল হয়ে জাতীয় সড়ক দিয়ে যেত দিল্লি। জাহাজেও যেত কিছু পণ্য। সেখান থেকে তৃতীয় দেশে রপ্তানি হতো। তিনি জানান, পেট্রাপোলে প্রতিদিন যদি ২০০ গাড়ি আসত, তার ৪০ শতাংশ থাকত এই ধরনের পণ্য, অর্থাৎ ট্রান্সশিপমেন্টের গাড়ি। পণ্যগুলো বাংলাদেশ থেকে আসত, তা আমাদের না এবং আমাদের দেশে বিক্রিও হয় না। সেগুলো বিক্রি হয় বিদেশে। তারা আমাদের বন্দরটি ব্যবহার করত মাত্র। কিন্তু যারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা ৪০ শতাংশ কাজ হারাল। ট্রান্সশিপমেন্টে যেসব ট্রাক বা ট্রেলার যুক্ত ছিল, তারা কাজ হারাল। লজিস্টিক কোম্পানিগুলো যারা বন্দর পর্যন্ত এই পণ্যগুলো পৌঁছে দিত, তারাও কাজ হারাল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত