ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ট্রাম্প কি পিছু হটলেন নাকি অন্য কিছু

ট্রাম্প কি পিছু হটলেন নাকি অন্য কিছু

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর আরোপ করা শুল্ক অন্তত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন। ট্রাম্প জানিয়েছে, এরই মধ্যে বিশ্বের ৭৫টির বেশি দেশ শুল্কের বিষয়ে আলোচনায় বসতে চেয়েছে। সে জন্যই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মূলত বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে অভিযোগ এনেছে তা সমাধান করতে রাজি ভুক্তভোগী দেশগুলো। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পরই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বাজার ব্যবস্থা। এরই মধ্যে দেশে দেশে শেয়ারবাজারগুলোতে সূচক বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। দূর হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা।

২ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্প সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেন। এরপরই বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলোর শেয়ারবাজারে ধস নামে। বাড়ানো হয় অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস। অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায় ব্যবসা। তবে হঠাৎ করেই শুল্ক স্থগিত করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রমাণ করলেন তার বাণিজ্য নীতির ফলাফল সম্পর্কে তিনি অবগত। তবে শুল্ক স্থগিত করলেও এখনও কয়েকটি উদ্বেগের বিষয় থেকে গেছে। এই শুল্ক নীতির সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে চীনকে বাদ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক স্থগিত তো দূরের কথা আরও বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর আগে চীনা পণ্যের ওপর মার্কিন প্রশাসন ১০৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে ৮৪ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে চীন। বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির এই পাল্টা-পাল্টি পদক্ষেপে বাণিজ্যযুদ্ধ আরও তীব্র হয়েছে।

চীনা পণ্যে নতুন করে শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, বিশ্ব বাজারের প্রতি চীন যে অসম্মান দেখিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে আমি তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করার ঘোষণা দিচ্ছি। এটি এখন থেকেই কার্যকর হবে। অদূর ভবিষ্যতে চীন হয়তো এটা বুঝতে সক্ষম হবে যে, তাদের অন্য দেশগুলো ও আমেরিকার ক্ষতি করার দিন শেষ হয়ে এসেছে। তবে ট্রাম্প আরও বাণিজ্যের ব্যাপারে আগ্রহী এবং প্রশাসনও আলোচনার জন্য প্রস্তুত বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট।

এদিকে ট্রাম্প শুধু অতিরিক্ত শুল্কারোপের বিষয়টি স্থগিত রেখেছেন। যেসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বেশি তাদের ওপর এই অতিরিক্ত শুল্ক বসানো হয়েছিল। তবে সর্বজনীন যে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল তা বহাল থাকবে। তাছাড়া গত মাসে গাড়ি ও এর যন্ত্রাংশের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। পাশাপাশি ফার্মাসিউটিক্যালস ও সেমিকন্ডাক্টরের ওপরও নতুন মার্কিন শুল্ক আসতে যাচ্ছে। এখন ৯০ দিনের জন্য অতিরিক্ত শুল্ক স্থগিত করে বিশ্ব বাণিজ্যকে স্বস্তির পথে আনলেও ট্রাম্প মার্কিন গড় শুল্কের হার প্রায় এক শতকের মধ্যে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ করেছেন।

সবশেষ উদ্বেগটি হলো ট্রাম্প তার এই শুল্ক ব্যবস্থা একেবারে বন্ধ করে দেননি, শুধু স্থগিত করেছেন। তিনি আবারও যে কোনো সময় শুল্কের হুমকি সামনে নিয়ে আসতে পারেন।

শুল্ক নীতি- পশ্চাদপসরণ নাকি আলোচনার কৌশল ট্রাম্পের : চীন ছাড়া বাকি সবার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্কারোপ ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘পাল্টা শুল্ক’ কার্যকর হওয়ার দিনেই এই স্থগিতাদেশ দেন তিনি। শুল্কনীতি কার্যকরের বিষয়ে বড় ঘোষণার পর সেখান থেকে পিছিয়ে আসার বিষয়ে ট্রাম্পের এই ঘোষণা আসলে পশ্চাদপসরণ নাকি অলোচনার কৌশল তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, গত কয়েকদিন ধরে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও হোয়াইট হাউস বারবার জোর দিয়ে বলেছিল- তারা বহু দেশকে লক্ষ্য করে ‘পারস্পরিক’ শুল্ক আরোপে পুরোপুরি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এমনকি গত মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে যখন বলা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৯০ দিনের বিরতির কথা ভাবছেন, তখন ট্রাম্প প্রশাসন তা অস্বীকার করেছিল। যদিও সেই গুজবই সাময়িকভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল শেয়ারবাজারে।

কিন্তু বাস্তবতা এখন বলছে, সেই বিরতিই কার্যকর হয়েছে। কিছু ব্যতিক্রম বাদে, অধিক হারে শুল্ক আরোপ আপাতত স্থগিত। ফলে ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নতুন করে সাজানোর’ পরিকল্পনা থেমে গেছে, আর ট্রাম্প যে ‘আমেরিকান উৎপাদনের সোনালি যুগ’ আনার কথা বলেছিলেন, সেটিও আপাতত পিছিয়ে গেল।

হোয়াইট হাউস দাবি করেছে, শুরুতে বড় ঘোষণা দিয়ে পরে আলাদা আলাদা দেশের সঙ্গে আলোচনায় যাওয়ার কৌশলটাই নাকি ছিল আসল পরিকল্পনা। মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে এরইমধ্যে ৭৫টিরও বেশি দেশ যোগাযোগ করেছে। আজকের পর সংখ্যাটি আরও বাড়বে বলেই মনে করি।’ তবে হোয়াইট হাউসের এমন ব্যাখ্যা খুব একটা অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ ঘোষণার আগে থেকেই বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ, বন্ড বাজারে ধস, রিপাবলিকানদের সমালোচনা এবং জনমনে অসন্তোষ দৃশ্যমান ছিল। ফলে এই প্রশ্ন উঠছে- এটি কি প্রতিরোধের মুখে কৌশলগত পশ্চাদপসরণ নাকি ট্রাম্পের বিখ্যাত ‘আর্ট অব দ্য ডিল’ কৌশলের আরেকটা দৃষ্টান্ত? অবশ্য ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের অনেকে- যারা এতদিন বলছিলেন প্রেসিডেন্ট কখনওই পিছু হটবে না- তারা এখন এই বিরতিকে ‘বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ’ হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেছেন। বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো বলেন, ‘শুল্ক ইস্যু ঠিক যেমনটা হওয়া উচিত, তেমনভাবেই এগিয়েছে।’

হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা বুঝতেই পারেননি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আসলে কী করছেন। পুরো বিশ্ব এখন যুক্তরাষ্ট্রকে ফোন করছে।’

তবে বিরতির বিস্তারিত বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান ছিল অস্পষ্ট। ট্রাম্প নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে শুধু একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ছাড় দেয়া হয়েছে কি না, মেক্সিকো ও কানাডা- যারা প্রথম ১০ শতাংশ শুল্কের বাইরে ছিল- এবার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি না, কিংবা নির্দিষ্ট খাতের ওপর প্রভাব পড়েছে কি না, এসব প্রশ্নের উত্তর মিলছিল না।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে অবশেষে হোয়াইট হাউস বিষয়টা কিছুটা স্পষ্ট করে। তবে এর আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক অংশীদার দেশগুলো ট্রাম্পের পোস্ট ও সাংবাদিকদের চিৎকার করে করা প্রশ্ন থেকে তথ্য জোগাড় করতেই ব্যস্ত ছিল। গত বুধবার বিকালে ট্রাম্প স্বীকার করেন, বাজার ‘মলিন’ দেখাচ্ছিল এবং ‘মানুষ কিছুটা অস্থির হয়ে পড়েছিল’- যা গত সপ্তাহের তার আত্মবিশ্বাসী বক্তব্যের বিপরীত ও এ সিদ্ধান্তের প্রকৃত কারণের আভাস দেয়। তবে একই দিনে তিনি ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, ‘শান্ত হও!’ এবং আশ্বস্ত করেন, ‘সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে।’ তার আগের দিন যারা ট্রাম্পের পদক্ষেপ নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন- তাদের উদ্দেশে তিনি (ট্রাম্প) বলেন, ‘তোমরা দুর্বল ও বোকা’, ‘অপেক্ষা কর’। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প নিজেই পথ বদলালেন। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, শুল্ক নিয়ে তার ঘোষণাটি ‘দরকারি’ ছিল এবং যদি এতে কোনো অর্থনৈতিক অস্থিরতা হয়, তাহলে সেটি আমেরিকান অর্থনীতির দীর্ঘদিনের অসুস্থতার প্রতিফলন।

অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা প্রত্যাশিতভাবেই অন্যরকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সিনেটের সংখ্যালঘু দলনেতা চাক শুমার বলেন, ‘এই প্রেসিডেন্ট বিশৃঙ্খলার মাধ্যমেই দেশ চালান। তিনি এখন দিশাহারা, পিছু হটছেন- এটাই ভালো খবর।’

সবশেষে ট্রাম্প কী ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটা হয়তো অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, যেসব দেশ মার্কিন শুল্কের পাল্টা জবাব দিচ্ছিল, তাদের সঙ্গে এখন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কিছুটা ‘সুলভ’ হচ্ছে- যদিও ট্রাম্প এখনও সার্বিকভাবে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপে অটল, যা কয়েক সপ্তাহ আগেও বড় খবর হতো। এই পদক্ষেপেই শেয়ারবাজার বাউন্স ব্যাক করেছে। তবে এরই মধ্যে ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে নতুন বাণিজ্যযুদ্ধে নেমেছেন। এশিয়ার পরাশক্তি এই দেশটির ওপর তিনি ১২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন।

এই পদক্ষেপ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে, তবে এটি সাম্প্রতিক আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ- যার মধ্যে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নীতিও আছে যেখানে চীনের আধিপত্য রোধ করাই মূল লক্ষ্য। সবচেয়ে বড় অজানা প্রশ্ন হচ্ছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ট্রাম্পের এসব তৎপরতাণ্ড মিত্রদের বিপাকে ফেলা এবং বিশ্ব ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দেওয়া- তার নতুন কৌশলকে সফল করার পথ আরও কঠিন করে তুলবে কি না। আর ৯০ দিনের মাথায়, যখন এই বিরতির মেয়াদ শেষ হবে, তখন কি আবারও এই সপ্তাহের মতো অর্থনৈতিক নাটক ও অনিশ্চয়তা ফিরে আসবে?

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত