ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান গণহত্যার জবাবে দখলকৃত জাফা অঞ্চলের দুটি ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইয়েমেনের হুথি আনসার-আল্লাহর নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী। শুক্রবার বাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়, দুটি ‘ইয়াফা’ ড্রোন ব্যবহার করে চালানো এই হামলা ছিল গাজার ফিলিস্তিনি জনগণ এবং এর সাহসী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রতি অবিচল সমর্থনের অংশ। এদিন গাজাসিটির শেজাইয়া এলাকায় ইসরায়েলের ভয়াবহ বিমান হামলায় ২৯ জন বেসামরিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। আহত হন ৫০ জনেরও বেশি মানুষ এবং বহু মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৫০ হাজার ৯১২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এই গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনিদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে ইয়েমেনের সশস্ত্র বাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা থামব না। যতক্ষণ না আগ্রাসন বন্ধ হবে এবং অবরোধ প্রত্যাহার না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত গাজার পাশে থাকা আমাদের ধর্মীয়, নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব।’ এদিকে, ইসরায়েলে হামলার আগে লোহিত সাগরে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস হ্যারি ট্রুম্যানে আবার প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় ইয়েমেনের সশস্ত্র বাহিনী। এর আগে বুধবার তারা মাত্র ১০ দিনের মাথায় তৃতীয় মার্কিন এমকিউ-নাইন রিপার ড্রোন ভূপাতিত করেন। প্রায় ৩৩ মিলিয়ন ডলার মূল্যের এই নজরদারি ও স্ট্রাইক ড্রোন গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে ব্যবহার করে মার্কিন সামরিক বাহিনী।
ইয়েমেনে ১০ লাখ মানুষের বিক্ষোভ : এদিকে, গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতিবাদে শুক্রবার ইয়েমেনে প্রায় ১০ লাখ মানুষের বিক্ষোভ হয়েছে। এদিন সানা, সা-দা, বাইদা, হাজ্জাহ ও ধালেসহ বিভিন্ন শহরের লোকজন রাস্তায় নেমে আসেন। গাজাপন্থি প্রতিশোধমূলক অভিযান বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনের ওপর যে বর্বর হামলা চালাচ্ছে, বিক্ষোভে এর তীব্র নিন্দা জানানো হয়। ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনের পতাকা হাতে বিক্ষোভকারীরা বলেছেন, ‘আমরা ন্যায্য অবস্থান থেকে সরব না। যে আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইদের আঘাত করবে, আমরা তাকে আঘাত করব।’ তারা স্লোগান দেন, ‘হে গাজা, হে ফিলিস্তিনি, আমরা কেয়ামত পর্যন্ত তোমাদের সঙ্গে আছি।’ বিক্ষোভের আয়োজকরা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘মার্কিন আগ্রাসন ইয়েমেনি জনগণকে পিছু হটাতে পারবে না। বরং, ফিলিস্তিনের প্রতি তাদের ঈমানি চেতনা আরও দৃঢ় হবে।’ মার্কিন-ইসরায়েলি পরিকল্পনার ব্যর্থতা তুলে ধরে তারা বলেছেন, ‘গাজায় হামলার মাধ্যমে তারা একজন বন্দিকেও উদ্ধার করতে পারেনি। প্রতিরোধ সংগ্রামকে নির্মূল করতে তাদের সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। ইয়েমেনিরা তাদের একটি জাহাজকেও লোহিত সাগর পাড়ি দিতে দেননি।’ বিক্ষোভকারীরা নীরবতা ভেঙে গাজার সমর্থনে শক্ত পদক্ষেপ নিতে আরব ও মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
যুদ্ধবিরোধী এক হাজার ইসরায়েলি সেনা বরখাস্ত : ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা এখন তুঙ্গে। অবরুদ্ধ গাজায় আর যুদ্ধ চাচ্ছেন না বিপুল সংখ্যক ইসরায়েলি সেনা। এর জেরে চলমান যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেয়ার পর প্রায় এক হাজার রিজার্ভ সেনাকে বরখাস্ত করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়াল জামির তাদের বরখাস্তের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন। এর আগে চলতি সপ্তাহের শুরুতে ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর কয়েকশ’ সদস্যসহ বরখাস্তকৃতদের অনেকে একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। চিঠিতে তারা গাজায় চলমান যুদ্ধকে ‘নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থে পরিচালিত’ বলে উল্লেখ করেন। তারা আরও লেখেন, যুদ্ধ চালিয়ে বন্দিদের মুক্ত করা সম্ভব নয়, বরং যুদ্ধবিরতির মাধ্যমেই এর সমাধান হতে পারে। চিঠি দেওয়ার বিষয়টিকে ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ‘গুরুতর অপরাধ’ হিসেবে অভিহিত করেন। তার মতে, যারা এই ধরনের বিবৃতি দিয়েছেন, তারা সেনাবাহিনীতে ফিরে আসার যোগ্য নন।
অন্যদিকে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ-ও এই চিঠির নিন্দা জানিয়ে বলেন, এটি যুদ্ধের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টা। ইসরায়েলি গণমাধ্যম জানিয়েছে, চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ড্যান হালুৎস, সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল নিমরড শেফার এবং সাবেক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নেরি ইয়ারকোনির মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। চিঠিতে তারা যুদ্ধ বন্ধ করে বন্দিদের ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের ওপর সর্বাত্মক চাপ প্রয়োগ করতে সব ইসরায়েলি নাগরিকের প্রতি আহ্বান জানান। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ এখনও সক্রিয় রিজার্ভ ডিউটিতে রয়েছেন, বাকিরা সাবেক বা অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য।
ফিলিস্তিনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান জানাল সৌদি : ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতির প্রস্তাব আবার প্রত্যাখ্যান করেছে সৌদি আরব। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান স্পষ্টভাবে বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির যেকোনো পরিকল্পনাকে সৌদি আরব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। শুক্রবার তুরস্কের আনাতোলিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন টু এন্ড দ্য ওয়ার অন গাজা’-র মন্ত্রিপর্যায়ের কমিটির বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। বিন ফারহান এ সময় অভিযোগ করে বলেন, ‘গাজার বাসিন্দারা ন্যূনতম জীবনধারণের সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত।’ তিনি বলেন, গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশের বিষয়টি যুদ্ধবিরতির সঙ্গে শর্তযুক্ত করা উচিত নয়। বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত সহায়তা সরবরাহে বাধা দূর করতে একযোগে কাজ করা। প্রিন্স ফয়সাল গাজা যুদ্ধবিরতির জন্য চলমান আলোচনার প্রতি সৌদি আরবের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মিসর ও কাতারের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি।
বৈঠক শেষে প্রকাশিত এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, গাজা, পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুজালেম থেকে ফিলিস্তিনিদের যেকোনো ধরনের জোরপূর্বক স্থানান্তর বা বিতাড়নের বিরোধিতা করছেন তারা। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা আনরোয়ার প্রতিও সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এতে গাজা, পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুজালেমকে একত্র করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে আনার আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে অবিলম্বে একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দাবি জানানো হয়, যা জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী হওয়া উচিত। তাছাড়া, দখলকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, যেমন- বসতি সম্প্রসারণ, ঘরবাড়ি ধ্বংস ও জমি দখলের কঠোর নিন্দা জানানো হয় যৌথ বিবৃতিতে।
ইসরায়েলকে গণহত্যাকারী বললেন এরদোয়ান : ইসরায়েলকে সন্ত্রাসী ও গণহত্যাকারী আখ্যা দিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, গাজা সহিংসতা গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। শুক্রবার তুর্কি প্রেসিডেন্ট আনাতোলিয়া ডিপ্লোম্যাসি ফোরামে বলেন, গাজায় এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার ৮০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে নারী, শিশু ও সাংবাদিকও রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটা যদি বর্বরতা না হয়, তাহলে বর্বরতা কাকে বলে? এই বর্বরতায় নীরব থাকা মানে অপরাধে অংশীদার হওয়া।’ আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবেই তিনি ইসরায়েলের আচরণকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদসহ বিশ্বের শক্তিধরদের এ সহিংসতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
তুরস্কের অবস্থান স্পষ্ট করে এরদোয়ান বলেন, তার দেশ ১৯৬৭ সালের সীমান্তভিত্তিক দ্বি-রাষ্ট্র নীতিকে সমর্থন করে এবং পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দেখতে চায়। এই অবস্থানের অংশ হিসেবে তুরস্ক ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য স্থগিত করেছে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার করা জাতিগত নিধনের মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়েছে। সিরিয়া প্রসঙ্গে এরদোয়ান বলেন, ইসরায়েল সেখানে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বিভাজন উসকে দিয়ে ‘৮ ডিসেম্বর বিপ্লব’-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারা সিরিয়ার সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে গোটা অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করছে। তিনি আরও বলেন, ইসরায়েল এমন একটি সমস্যা হয়ে উঠেছে, যা সরাসরি গোটা অঞ্চলকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে।
পাকিস্তানে লাখো মানুষের সমাবেশ : গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে শুক্রবার লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। জামায়াতে ইসলামীর ডাকে আয়োজিত এই বিক্ষোভে মুসলিম দেশগুলোকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। লাহোরে এক বিশাল সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর আমির হাফিজ নাঈমুর রহমান বলেন, এই দখলকৃত ভূখণ্ডকে মুক্ত করা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব। ব্যক্তিগতভাবে পথ বন্ধ থাকলে এই দায়িত্ব মুসলিম শাসকদের ও তাদের সেনাবাহিনীর। পাকিস্তান ও ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ও আদর্শিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে নাঈমুর রহমান বলেন, ১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েলকে জোর করে মধ্যপ্রাচ্যে চাপিয়ে দেওয়া হলো, তখন আমাদের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, ইসরায়েল পশ্চিমা শক্তির তৈরি একটি অবৈধ সন্তান। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, পাকিস্তানের জাতীয় কবি ও দার্শনিক ড. মোহাম্মদ ইকবাল ১৯৩১ সালে ফিলিস্তিনে একটি সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন, যা ফিলিস্তিনের প্রতি পাকিস্তানের অঙ্গীকারের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।
নাঈমুর রহমান বলেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিতে বলা হয়েছে, আমরা ইসরায়েলকে কখনও স্বীকৃতি দেব না। কেউ যদি গোপনে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষে কথা বলেন কিংবা ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেন, তাহলে আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, রাষ্ট্র একটাই ছিল এবং থাকবে, সেটি হলো ফিলিস্তিন। তিনি বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোর ওপর গণচাপ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনার সরকারকে প্রতিবাদের মাধ্যমে চাপ দিন। বাংলাদেশ, ভারত, ইউরোপ, আমেরিকাণ্ড সর্বত্র বিক্ষোভ চলছে। এই প্রতিরোধের আগুন নিভতে দেবেন না। জামায়াতের পক্ষ থেকে ইসরায়েল এবং তাকে সমর্থনকারী কোম্পানিগুলো পণ্য বর্জনেরও আহ্বান জানানো হয়।