গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরইমধ্যে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এরই অংশ হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রাথমিক প্রার্থী বাছাই শুরু করেছে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। প্রার্থী বাছাইয়ে অনেকটা ‘চিরুনি অভিযান’ চালাচ্ছে দলটি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের একটি টিম আসনভিত্তিক সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা প্রণয়নের কাজ করছে। আগামী দুই থেকে তিন মাস প্রার্থিতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নেয়া হবে।
এবারের নির্বাচনে গুরুত্ব পাবে তরুণ ও পরিচ্ছন্নরা। যারা বিতর্কিত, তারা রয়েছেন রেড জোনে। একিট বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা গেছে, কমপক্ষে ১০০ আসনে দলটির প্রার্থিতায় নতুন মুখ দেখা যেতে পারে। এতে কপাল পুড়তে পারে অনেক হেভিওয়েট প্রার্থীর। সূত্রমতে, অপকর্মে জড়িত বা বিতর্কিত কাউকে এবার মনোনয়ন দেবে না দলটি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দল থেকে যাদের চূড়ান্ত প্রার্থী করা হয়েছিল, যারা দলের প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছিলেন এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত, বিশেষ করে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর-পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পৃক্ত ত্যাগী ও ক্লিন ইমেজধারীদের দিয়ে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকার খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। আগামী জুলাই-আগস্টের মধ্যে এই খসড়া তালিকা তৈরির কাজ সম্পন্ন করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, ‘বিএনপি গণতন্ত্র ও দেশের সার্বিক উন্নয়নে বিশ্বাসী একটি দল। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে আমরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী কায়দায় ক্ষমতায় টিকে ছিল। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ তৈরি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ বলা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বাছাইয়ে কাজ করে যাচ্ছে দলের হাইকমান্ড। এবারের নির্বাচনে মূলত দলের জন্য ত্যাগী ও পরিচ্ছন্ন ইমেজের নেতাদেরই বেশি মূল্যায়ন করা হবে। যারা বিতর্কিত তারা রয়েছেন দলের রেড জোনে। বিশেষ করে যারা ৫ আগস্ট-পরবর্তী চাঁদাবাজি ও নানা বিতর্কের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন, তারা প্রার্থী বাছাইয়ে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে হেভিওয়েট অনেক প্রার্থী বাদ পড়তে পারেন। আবার অনেক তরুণ প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেতে পারেন।’
জানামতে, চূড়ান্ত রোডম্যাপ এখনও ঘোষিত না হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারণা দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী প্রতিটি দলই এখন নির্বাচনমুখী তৎপরতায় সম্পৃক্ত হয়েছে। বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো আসনভিত্তিক কাজ শুরু করেছে। দুয়েকটি দল এরইমধ্যে তাদের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা করেছে এবং সে অনুযায়ী নির্বাচনের মাঠে কাজও শুরু করেছে। তবে বিএনপি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তৎপরতা শুরু না করলেও গত ফেব্রুয়ারিতে দলের বর্ধিত সভা থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তৃণমূল নেতাদের নির্বাচনের জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা দেন।
জানা গেছে, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার পরই আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনি তৎপরতা শুরু করবে দলটি। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই নির্বাচনি এলাকায় যোগাযোগ বাড়িয়েছেন প্রার্থীরা, আছেন গণসংযোগের মধ্যে। দলের নির্দেশনা মেনে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারা। নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে রমজানজুড়ে এলাকায় ইফতার মাহফিল করেছেন, ঈদুল ফিতরও উদযাপন করেছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বাস্তবতা বিবেচনায় বিএনপি প্রতিটি আসনে প্রাথমিকভাবে তিন থেকে চারজনকে মনোনয়ন দিয়েছিল। কারণ, বিএনপিকে নির্বাচনের মাঠে দাঁড়াতে দেয়া হবে কি না, দল তখন এমন একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিল। তাই প্রথম প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হলে দ্বিতীয়জন নির্বাচন করবেন; দ্বিতীয়জনের প্রার্থিতা বাতিল হলে পরেরজন নির্বাচন করবেন- এমন চিন্তা-ভাবনা থেকে দলীয় কৌশলের অংশ হিসেবে তখন এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে তেমন কিছু ঘটবে না। দলীয়ভাবে একজনকেই মনোনয়ন দেয়া হবে। একইসঙ্গে দলীয় সেই প্রার্থীকে বিজয়ী করতে বাকিদের কড়া নির্দেশনাও দেয়া হবে, যাতে সবাই সম্মিলিতভাবে প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন। জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি কোনো ধরনের গ্রুপিং বরদাশত করবে না। একইসঙ্গে যাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি-দখলদারিত্বসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে, তাদেরও মনোনয়ন দেবে না। সম্ভাব্য প্রার্থীদের এরই মধ্যে দলের এমন কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছে। এতে করে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা অনেক ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন এবং সে অনুযায়ী এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে তার একটি টিম কাজ করছে। দলটি আসনভিত্তিক জরিপও চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আসনভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দলের সম্ভাবনা কতটুকু, দলীয় অবস্থান কেমন এসব বিষয় জরিপে তুলে আনা হবে।
বিএনপির দায়িত্বশীল একজন নেতা জানিয়েছেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আগামী নির্বাচনে পরিচ্ছন্ন প্রার্থীদের গুরুত্ব দেবেন। ওই নেতা এও জানান, আগামী নির্বাচনে কমপক্ষে ১০০ আসনে নতুন তরুণ মুখ দেখা যেতে পারে।
বিএনপি মনে করছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন খুব সহজ হবে না। নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে বিএনপির বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপ-প্রচার, প্রোপাগাণ্ডা চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ দলটির। নেতারা বলছেন, বিএনপির জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাদের ঘায়েল করার জন্যই এটা করা হচ্ছে। তাদের আশা, গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির যে ত্যাগ, দেশের মানুষ সেটা ভুলে যায়নি। আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে দলটির নেতাকর্মীরা যে হামলা-মামলা, গুম-খুনের শিকার হয়েছে, তাদের এই সংগ্রাম, ত্যাগের কথা বিবেচনা করে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে জনগণ বিএনপিকেই বেছে নেবে। ফলে দলটি আশাবাদী, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে তারা আগামীতে সরকার গঠন করবে। যদিও বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বী অপরাপর দলগুলোকেও সমীহ করছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনি জোট গঠন করে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে বিএনপি। তবে নির্বাচনি জোট গঠনের ক্ষেত্রে দলটি এখন পর্যন্ত সেভাবে মনোযোগী না হলেও আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সেই তৎপরতা শুরু হতে পারে। নির্বাচনি সেই জোটে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা যথারীতি বিএনপির সঙ্গে থাকবে। এছাড়া দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় থাকা ইসলামপন্থি ও বামধারার দলগুলোকে জোটে আনা যায় কি না, সেই প্রচেষ্টাও থাকবে বলে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায় থেকে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বিএনপির অবস্থান হচ্ছে, নির্বাচনে বিজয়ী হলে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করবে। সেই জাতীয় সরকার বাংলাদেশে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। আমরা নির্বাচনের জন্য সব সময়ই প্রস্তুত আছি। সব আসনেই আমাদের একাধিক প্রার্থী রয়েছে। তবে এবার দলের জন্য নিবেদিতরাই বেশি মূল্যায়িত হবেন।’