আজ পহেলা বৈশাখ। নতুন পুরোনো সব বিভেদ ভুলে নতুন আলোয় আলোকিত হোক নতুন বছর, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’। সময়ের চাকা ঘুরে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে আজ শুরু হলো ১৪৩২ সনের দিন গণনা। বৈশাখ মাসের এই প্রথম দিনটি আমাদের সব সঙ্কীর্ণতা, কূপমুণ্ডকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবনব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মনের ভেতরের সব ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে; আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। গত বছর ৫ই আগস্ট দীর্ঘ ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর এবার ভিন্ন আমেজে পালিত হবে বাংলা বর্ষবরণ আয়োজন। বর্ষবরণ আয়োজনের স্লোগান হচ্ছে ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্য নিয়ে। এবারের বাংলা নববর্ষের উদযাপনে থাকছে ভিন্নতা। সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে শুরু হবে ‘আনন্দ শোভা যাত্রা’। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ঘৃণা জানিয়ে সবার সামনে থাকবে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে ২০০ শিল্পী পতাকা হাতে গান গাইবেন। পুরো আয়োজনজুড়ে আরও থাকছে জুলাই আন্দোলনের আবহ। আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই বার্তা দিয়ে সকাল ৬টায় রাজধানীর রমনার বটমূলে বরাবরের মতো ছায়ানট বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেবে। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ সরকারি ছুটি। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হবে নববর্ষ উপলেক্ষ নানা আয়োজন। দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র।
চারুকলা থেকে আনন্দ শোভা যাত্রায় যুক্ত হবে ফ্যাসিস্ট হাসিনার মুখাবয়ব। আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজনে থাকছে বড়, মাঝারি ও ছোট মোটিফ। এর মধ্যে বড় মোটিফ থাকবে ছয়টি। সবার সামনে থাকবে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’। নারীর দাঁতাল মুখাবয়বে মাথায় রয়েছে খাড়া দুটো শিং।
শোভাযাত্রায় বড় মোটিফের মধ্যে থাকবে কাঠের বাঘ, ইলিশ মাছ, ৩৬ জুলাই (টাইপোগ্রাফি), শান্তির পায়রা, পালকি, জুলাই আন্দোলনে নিহত মুগ্ধের পানির বোতল।
এছাড়া অন্যান্য মোটিফের মধ্যে থাকবে ১০টি সুলতানি ও মুঘল আমলের মুখোশ, ৮০টি ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, ২০টি রঙিন চরকি, ২০০টি বাঘের মাথা, ৮টি তালপাতার সেপাই, পলো ১০টি, ৫টি তুহিন পাখি, ৬টি মাছের চাঁই, ৪টি পাখা, ২০টি মাথাল, ২০টি ঘোড়া, ৫টি লাঙল, ৫টি মাছের ডোলা এবং ১০০ ফুট লোকজ চিত্রাবলীর ক্যানভাস থাকবে।
চারুকলার সম্মুখভাগের দেয়ালে আঁকা হয়েছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ির মোটিফ। জয়নুল শিশু নিকেতন দেয়ালে আঁকা হয়েছে সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী মাটির দেয়াল অমনরীতি অবলম্বনে চিত্র।
এবারের শোভাযাত্রায় অন্যান্য মোটিফের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মুসলমানদের লড়াই ও সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তাদের প্রতীক হিসেবে তরমুজের মোটিফ থাকবে। শোভাযাত্রায় ফিলিস্তিনি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ‘তরমুজ ফিলিস্তিনিদের কাছে’ ও ‘প্রতিরোধ ও অধ্যবসায়ের প্রতীক’। ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও মূলত এটি তাদের পতাকা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর কারণ হলো, ফলটির বাইরের অংশের রঙ সবুজ। আর ভেতরের অংশগুলোর রং লাল, সাদা ও কালো। এ রঙগুলো ফিলিস্তিনের পতাকার রঙের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।’ আনন্দ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানমালায় এবার বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে অংশ নেবেন দুই শতাধিক সংগীতশিল্পী। শুধু তাই নয়, শোভাযাত্রায় ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে শান্তির বার্তা দেবেন তারা। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ২০০’র বেশি সংগীত শিল্পী অংশ নেবেন, পাশাপাশি ফিলিস্তিনি পতাকা ও তাদের প্রতি সমর্থনমূলক গান পরিবেশিত হবে। তিনি বলেন, পাশাপাশি ঢাকার আশপাশের যত মিউজিসিয়ান আছেন, যারা গিটার বাজাতে পারেন তাদের অনুরোধ করব, আপনারা গিটারটা নিয়ে র্যালিতে চলে আসেন এবং সঙ্গে ফিলিস্তিনের একটা পতাকা রাখবেন। ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে ফারুকী বলেন, ফিলিস্তিনের জন্য যে গান এবং শোভাযাত্রা এটাকে আমি মনে করি, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন এবারের শোভাযাত্রায়। আমি বাংলাদেশের রক মিউজিসিয়ানদের ধন্যবাদ জানাই। কারণ এ কাজ রক মিউজিসিয়ানদের ছাড়া সম্ভব না। নববর্ষ বরণের আনন্দ শোভাযাত্রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে সকাল ৯টায় শুরু হবে। অংশগ্রহণকারীদের নিজ নিজ পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে হবে। একইসঙ্গে বিকাল পাঁচটার মধ্যে নববর্ষের সব অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে। গতকাল রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ছায়ানটের উদ্যোগে রাজধানীতে বর্ষবরণের প্রথম আয়োজন রমনা বটমূলে শুরু হবে। সকাল সোয়া ৬টা থেকে শুরু হবে মূল পরিবেশনা। এতে অংশগ্রহণ করবেন নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রায় দেড়শত শিল্পী। থাকবে বৈশাখি গান ও কবিতা। মোট ২৪টি পরিবেশনার মধ্যে ৯টি সম্মিলিত গান, ১২টি একক গান ও কবিতা থাকবে তিনটি। এবারের নববর্ষের মূল কথন পাঠ করবেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী। ছায়নট কর্তৃপক্ষ জানায়, মূল পরিবেশনায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পুরুষরা পরবেন মেরুন রঙের পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা। আর নারীরা পরবেন মেরুন পাড়ের অফ হোয়াইট শাড়ি। শাড়ির কপাটের সঙ্গে মিল রেখে এরইমধ্যে মঞ্চের ডিজাইনেও স্থান পেয়েছে মেরুন রঙ। যদিও গত বছর এর রং ছিল সবুজ। এবারের বাংলা নববর্ষের মূল বার্তা আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। আলো, প্রকৃতি, মানুষ দেশপ্রেমের গান।