সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই মডেল মেঘনা আলমকে রাজধানীর বসুন্ধরার বাসা থেকে আটক করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। তাকে আটকের ঘটনা নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। অপরাধে জড়ালে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার না করে তাকে কেন বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিতর্কিত প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন বা প্রতিরোধমূলক আটক করা হলো, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এমন প্রেক্ষাপটে ডিএমপির ডিবির প্রধানের পদ থেকে রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। গত শনিবার ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ের এক আদেশে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
গত বুধবার রাতে মডেল মেঘনা আলমকে রাজধানীর বসুন্ধরার বাসা থেকে আটক করে ডিএমপির ডিবি। গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের মাধ্যমে মেঘনা আলমকে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাকে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেয়া হয়। তিনি এখন কারাগারে।
এদিকে মেঘনা আলমকে যে প্রক্রিয়ায় আটক করা হয়েছে, তা সঠিক হয়নি বলে গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তবে মেঘনা আলমের বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে বলে উল্লেখ করেন আসিফ নজরুল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুলিশ তদন্ত করছে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুব শিগগির উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘মডেল মেঘনা আলমকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডিটেনশন দিয়েছিল। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আপনাদের শুধু একটি জিনিস বলতে চাই, আমরা সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে মিটিং করেছি। আমরা এ ব্যাপারে বিভিন্ন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান এবং অন্য অনেকের বক্তব্যে সচেতন আছি। আমরা শুধু এটুকু আপনাদের বলতে পারি, মডেল মেঘনা আলমের ব্যাপারে পুলিশ কিছু তদন্ত করছে এবং ওনার বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। কিন্তু ওনাকে যে প্রক্রিয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বিশেষ ক্ষমতা আইনে, সেটা সঠিক হয়নি।’
আসিফ নজরুল আরও বলেন, মডেল মেঘনা আলমের যদি কোনো অপরাধ থাকে, সে অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়াটি ঠিক হয়নি, এটি তারা (সরকার) স্বীকার করছে। কিন্তু গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়াটি ঠিক হয়নি মানে তার বিরুদ্ধে অপরাধের কোনো আলামত বা অভিযোগ নেই- এটা না, সেরকম কিছু আছে। সেটির পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় আছে, সেটির ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুব শিগগির উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
মডেল মেঘনা আলমকে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার, কারণ উল্লেখ না করে গ্রেপ্তার, ২৪ ঘণ্টার বেশি গোয়েন্দা কার্যালয়ে হেফজতে রাখা প্রশ্নে রুলে দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে মেঘনা আলমকে দেয়া আটাকাদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে। একটি রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি রাজিক আল জলিল ও বিচারপতি তামান্না রহমান খালিদীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত রোববার এ রুল দেন। মেঘনা আলমকে আটকের প্রক্রিয়া ও আটকাদেশের বৈধতা নিয়ে তার বাবা বদরুল আলম রিট আবেদন দায়ের করেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী কাজী জাহেদ ইকবাল ও প্রিয়া আহসান চৌধুরী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ও জামিলা মমতাজ। রুলে পরোয়ানা ছাড়া বাসা থেকে মেঘনা আলমকে গ্রেপ্তার, কারণ না জানিয়ে গ্রেপ্তার, ডিবি কার্যালয়ে ২৪ ঘণ্টার বেশি হেফাজতে রাখা ও আইনজীবীর সুযোগ না দেয়া কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিশেষ ক্ষমতা আইনে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে দেয়া আটকাদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধান, ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
রেজাউলকে ডিবিপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আদেশ সই করেছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। আদেশে বলা হয়, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করিম মল্লিককে ডিএমপির সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। আদেশে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত প্রশাসনিক স্বার্থে রেজাউল করিম মল্লিককে তার নামের পাশে উল্লেখিত স্থানে পদায়ন করা হলো। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গত ১ সেপ্টেম্বর ডিএমপির ডিবিপ্রধানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রেজাউল।
ডিএমপি সূত্র জানায়, ১৭তম বিসিএস (পুলিশ) ব্যাচের কর্মকর্তা রেজাউল ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন। ডিএমপির ডিবিপ্রধান হওয়ার আগে তিনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মডেল মেঘনা আলমকে ভুল প্রক্রিয়ায় আটকের ঘটনার জের ধরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধানের পদ থেকে রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। মেঘনা আলমকে আটকের পর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি ক্ষতিকর কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, সেক্ষেত্রে ক্ষতিকর কাজ থেকে তাকে নিবৃত্ত রাখার জন্য আটক করতে পারেন। মডেল মেঘনা আলম ক্ষতিকর কাজের সঙ্গে যুক্ত। যে কারণে তাকে গত বুধবার রাতে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করে আটক রাখার আবেদন করে পুলিশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশ অনুযায়ী আদালত তাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিন আটক রাখার আদেশ দেন।
ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাযহারুল ইসলাম বলেন, মডেল মেঘনা আলমকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) আটক করে তাদের হেফাজতে রেখেছে। তবে কী কারণে মডেল মেঘনা আলমকে আটক করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো তথ্য জানাননি ওসি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত বুধবার রাতে মেঘনা আলমকে রাজধানীর বসুন্ধরার বাসা থেকে আটক করা হয়। মডেল মেঘনা আলম তখন ফেসবুকে লাইভ করছিলেন। তিনি দাবি করছিলেন, তিনি নিরপরাধ।
বিশেষ ক্ষমতা আইনে বলা হয়েছে, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী, ক্ষতিকর কাজ থেকে নিবৃত্ত রাখার জন্য সরকার যে কোনো ব্যক্তিকে আটক রাখার আদেশ দিতে পারবেন। আবার এই আইনের ৩(২) ধারা অনুযায়ী, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যদি সন্তুষ্ট হন এই আইনের নির্দিষ্ট ধারার ক্ষতিকর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত তাহলে ওই ব্যক্তিকে আটক রাখার আদেশ দেবেন। বিশেষ ক্ষমতা আইনের যেসব ক্ষতিকর কাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিকে আটক আদেশ দেয়া যায়, সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বা প্রতিরক্ষার ক্ষতি করা, বাংলাদেশের সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সংরক্ষণের ক্ষতি করা, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বা জননিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার ক্ষতি করা, বিভিন্ন সম্প্রদায়, শ্রেণি বা গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণাবোধ বা উত্তেজনা সৃষ্টি করা, আইনের শাসন বা আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা বা উৎসাহ প্রদান করা বা উত্তেজিত করা। ক্ষতিকর আরও কাজ হচ্ছে জনসাধারণের জন্য অত্যাবশ্যক সেবা বা অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করা, জনসাধারণ বা কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি বা আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বা আর্থিক ক্ষতি করা।