বিএনপির সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে বিএনপি নেতারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছে কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট কোনো সময়ের আশ্বাস মেলেনি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের সময় দিয়েছেন কিন্তু নির্বাচনের এই সময় নিয়ে একেবারে সন্তুষ্ট নয় বিএনপি। বৈঠক শেষে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় তার সুনির্দিষ্ট ডেটলাইন আমাদের দেননি। তিনি বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে তিনি নির্বাচন শেষ করতে চান। এ কথা তিনি আজ আবার বলেছেন।’ ‘আমরা তার দেয়া নির্বাচনের এই সময় নিয়ে একেবারেই সন্তুষ্ট নই। আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, ডিসেম্বরের কাট আউট টাইম, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন যদি না হয় দেশে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামাজিক পরিস্থিতি সেটা আরও খারাপের দিকে যাবে। সেটা তখন নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন হবে।’ এর আগে গতকাল বুধবার দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের উদ্দেশ্যে বিএনপির নেতারা যমুনায় প্রবেশ করেন। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক দুপুর ২টার দিকে শেষ হয়। বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন- বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সালাহউদ্দিন আহমেদ। অপরদিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।
নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়ে বিএনপি ‘একেবারেই সন্তুষ্ট নয়’ নয় বলে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের সময় দিয়েছেন, নির্বাচনের এই সময় নিয়ে আমরা একেবারে সন্তুষ্ট নই।
মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে তাকে আমাদের উদ্বেগের কারণ, কনসার্নগুলো জানিয়েছি। এবং প্রধান যে বিষয়টি ছিল সেটি হচ্ছে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ, যেটা আমরা বেশ কিছুদিন থেকে বলে আসছি সেই বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। আমরা বলেছি যে, বর্তমানে রাজনৈতিক যে পরিস্থিতি এবং দেশের যে অবস্থা তাতে আমরা বিশ্বাস করি এখানে একটি দ্রুত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্যে সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। একই সঙ্গে চলমান যে সংস্কার কমিশনগুলো করা হয়েছে, উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে, আপনারা জানেন যে, আমরা সেগুলোতে সম্পূর্ণভাবে সহযোগিতা করছি। গত কয়েকদিন আগে সে সংস্কারে আমাদের মতামত দিয়েছি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, স্পষ্ট করে বলেছি যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হবে সব দলের, সেগুলো নিয়ে আমরা একটি চার্টার করতে রাজি আছি। এরপরে সেটার ওপর ভিত্তি করে বাকি নির্বাচনের দিকে চলে যেতে পারি। বাকি সংস্কারে আমরা ঐকমত্য হবো, একমত হবো আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন তারা সেগুলো বাস্তবায়িত করার ব্যবস্থা নেবেন। এটিই ছিল আমাদের মূল কথা।
আপনাদের অবস্থান কী হবে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা আবারও আপনাদের সামনে আসব। দলের সঙ্গে, দলের অন্য মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করে আবার আপনাদের সামনে আসব।’
নির্বাচনের সময়সীমার ব্যাপারে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এটা ডিসেম্বরের কথাই বলা হয়েছে। উনি (প্রধান উপদেষ্টা) এ কথা বলেননি যে, ডিসেম্বরে হবে না। কিন্তু জুন পর্যন্ত নিয়েছেন। আমরা এ কথা পরিষ্কার করে বলেছি আওয়ার কাট আউট টাইম ইজ ডিসেম্বর।’
প্রধান উপদেষ্টাকে দেয়া বিএনপির চিঠিতে যা আছে: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দলের পক্ষ থেকে বেশ বড় একটি চিঠি লিখেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ‘দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দ্রুত করণীয় কিছু বিষয়ে মতামত ও পরামর্শ’ শীর্ষক এই চিঠিতে বিএনপি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-শ্রমিক জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান এবং শাসকদের পলায়নের কথা উল্লেখ করেছে। গতকাল বুধবার দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার হাতে চিঠিটি তুলে দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
চিঠিতে বিএনপি উল্লেখ করে, দীর্ঘ ১৬ বছরের লড়াইয়ে ১৭শ’র বেশি বিরোধী নেতাকর্মী গুম, সহস্রাধিক খুন এবং ৬০ লাখের বেশি নেতাকর্মী আহত, পঙ্গু ও গায়েবি মামলায় হয়রানির শিকার হয়েছেন। এছাড়াও, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে দুই সহস্রাধিক তরুণ, ছাত্র, শ্রমিক ও নারী-শিশু জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং আরও কয়েক হাজার আহত ও পঙ্গু হয়েছেন। বিএনপি এই ফ্যাসিবাদের পতন এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইকে অসীম আত্মত্যাগ ও সাহসী লড়াইয়ের এক গৌরবজনক ইতিহাস বলে অভিহিত করেছে।
চিঠিতে বলা হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিটি লড়াইয়ের নেতৃত্ব দানকারী বা সক্রিয় অংশীদার হিসেবে বিএনপি সর্বদা জনগণের কল্যাণে কাজ করে এসেছে। সেই লক্ষ্যে বিএনপি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে একটি টেকসই ক্ষেত্র তৈরির জন্য সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার ভার গ্রহণে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন জানিয়েছে এবং পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে ও সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে।
বিএনপি আশা প্রকাশ করে, অধ্যাপক ইউনূস ও তার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা হলো দ্রুত ফ্যাসিবাদী দল, তাদের দলীয় সরকার ও সহযোগীদের আইনের আওতায় এনে গণবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, দুর্নীতি ও লুটপাটের বিচার এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা, নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা, দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটানো এবং দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া।
বিএনপি মনে করে, একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধান, আইন, বিধি ও প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন ও সংস্কার অপরিহার্য। এক্ষেত্রে সরকারের যে কোনো উদ্যোগে তারা সমর্থন জানাবে।
চিঠিতে বিএনপি ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ এবং ‘আগে সংস্কার পরে গণতন্ত্র’ উভয় তত্ত্বকেই ভ্রান্ত আখ্যায়িত করে। তারা মনে করে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার মাধ্যমেই সবার জন্য উন্নয়ন সম্ভব এবং এর জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা, আইন ও নীতির সংস্কার জরুরি।
বিএনপি দাবি করে, দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ইতিহাসে প্রায় সবগুলো যুগান্তকারী সংস্কার তাদের হাত ধরেই এসেছে। তারা শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০ এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ২৭ দফা ও অন্যান্য দলের মতামত নিয়ে ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে। বিএনপি জানায়, সংস্কারের চলমান প্রক্রিয়া তাদের ঘোষণারই অংশ এবং তারা যে কোনো ‘যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনা’ স্বাগত জানায়। তবে, দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থে সময়ক্ষেপণ করে জনগণের ভোটাধিকার বঞ্চিত করার কৌশল তারা সমর্থন করে না।
বিএনপি এর আগে গত বছরের ২১ নভেম্বর ও চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টাকে তাদের কিছু উদ্বেগ ও পরামর্শ জানিয়েছিল, তবে সেসব বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে তারা উল্লেখ করে। এছাড়া ফ্যাসিস্ট সরকার কর্তৃক বৈষম্যের শিকার ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হলেও পদায়ন না করায় সরকারের কার্যক্রমে ব্যাহত হচ্ছে বলে বিএনপি মনে করে এবং দ্রুত তাদের পদায়নের দাবি জানায়।
চিঠিতে বিএনপি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী ও সরকারের বক্তব্যে ‘সমন্বয়ে’র উপর গুরুত্বারোপ করে এবং সম্প্রতি এর ‘ব্যতিক্রম’ তাদের ‘উদ্বিগ্ন’ করেছে বলে জানায়। তারা প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আস্থা রাখতে চায়, তবে তার সরকারের কিছু ব্যক্তি ও সমর্থনকারীদের বক্তব্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করে এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানায়।
বিএনপি আরও জানায়, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার ‘মহান দায়িত্ব’ প্রধান উপদেষ্টার উপর অর্পিত হয়েছে এবং তারা আশা করে যত দ্রুত সম্ভব তা পালন করা হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানায় বিএনপি। তারা এনআইডি প্রকল্প নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখা এবং নির্বাচনি এলাকা পুনর্নির্ধারণের আইনি জটিলতা দ্রুত নিরসনেরও প্রস্তাব করে।
একই সঙ্গে, বিএনপি ফ্যাসিবাদী দল ও তাদের সরকারের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচার, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ ও সুচিকিৎসা, দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন এবং ১/১১ ও ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। চিঠির শেষে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার মাধ্যমে জনমনে সৃষ্ট বিভ্রান্তি অবসানে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানান।