‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ গত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার এমন স্লোগান দিলেও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল। এতে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের আমদানি-রপ্তানির হার তলানিতে গিয়ে পৌঁছে। তবে, গত বছরের ৫ আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেছে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ বছর পর আজ রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিনের সঙ্গে পররাষ্ট্র দপ্তর পরামর্শ (এফওসি) বৈঠক হবে। গতকাল ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগের প্রধান ইশরাত জাহান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, উভয় পক্ষ দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। কোনো নির্দিষ্ট এজেন্ডা নির্ধারণ করা না হলেও আলোচনার সময় পারস্পরিক স্বার্থের সব বিষয়ই আলোচনায় থাকবে। গত প্রায় ১৫ বছর পর দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠকে আগেভাগে বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া কঠিন, তবে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা হবে। পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. ইকবাল হুসেন খান এই বৈঠকে যোগদানের জন্য বর্তমানে ঢাকায় রয়েছেন। তিনি বলেন, ঢাকার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে বিশেষভাবে আগ্রহী ইসলামাবাদ। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান বিশেষ করে তাদের পণ্যের দাম প্রতিযোগিতামূলক বিবেচনায় বাংলাদেশে রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছে। তুলাকে প্রধান পণ্য হিসেবে উল্লেখ করে পাকিস্তান তুলা সরবরাহ করতে আগ্রহী।
হাইকমিশনার বলেন, পাকিস্তান যেহেতু আফগানিস্তান ও ইরান থেকে পণ্যের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে। তাই পরিবহন খরচ কম হলে বাংলাদেশের জন্য পাকিস্তানের মাধ্যমে আমদানি অন্বেষণ করার সুযোগ রয়েছে।
সরাসরি বিমান যোগাযোগের বিষয়ে হাইকমিশনার খান বলেন, ফ্লাই জিন্নাহ ছাড়াও, শিয়ালকোটে অবস্থিত আরেকটি পাকিস্তানি বেসরকারি বিমান সংস্থা এয়ার সিয়াল ঢাকায় ফ্লাইট পরিচালনার জন্য সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অফ বাংলাদেশের কাছে আবেদন করেছে। অন্যদিকে, এয়ার সিয়াল অনুমোদন পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরাসরি বিমান সংযোগ পর্যটন বৃদ্ধি এবং দুদেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে।
দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ঐতিহাসিক সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে হাইকমিশনার বলেন, বিশ্বে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই ধরনের বিষয় বিদ্যমান থাকে, তবে বর্তমান সম্পর্ক বা অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে বাধাগ্রস্ত করা উচিত নয়। ঢাকায় অবস্থানকালে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব বালুচ বৃহস্পতিবার এফওসির পরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে পারেন। পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এই মাসের শেষের দিকে ঢাকা সফর করবেন। ২০১২ সালের পর বাংলাদেশে এটি হবে কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সফর। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সফরের তারিখ চূড়ান্ত করছি। তবে সফরটি এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের টানা প্রায় ১৫ বছরের শাসনামলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, আঞ্চলিক রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্তিমিত ছিল ঢাকার। অতীতের ‘টানাপোড়েন’ পেরিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘স্বাভাবিক সম্পর্ক’ চাওয়ার কথা এরইমধ্যে বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বৈঠকও হয়েছে। সেখানে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন তারা।
ইসলামাবাদের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনায় একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা এবং আটকেপড়া সম্পত্তি ফেরত ও ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন সব সময় সামনে আসে। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্ন বাদ রেখে সম্পর্কোন্নয়নের কোনো বার্তা পাকিস্তানকে না দেয়ার কথা বলেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। ইউনূস-শাহবাজ বৈঠকের পর দেশে ফিরে তিনি বলেছেন, দেশের স্বার্থ রক্ষা করে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়া হবে।
ওই বৈঠকে একাত্তরে ভূমিকার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি উঠেছে কি না, এমন প্রশ্নে মঙ্গলবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সৌজন্য সাক্ষাতে কঠিন বিষয়গুলো তোলা হয় না। যখন আলোচনার টেবিলে বসব, তখন এই বিষয় আলোচনা তুলব। একাত্তরকে বাদ রেখে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ও এগিয়ে নেয়া হবে কি না, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, না। আমরা মোটেই তাদের এ প্রসঙ্গে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করিনি যে, একাত্তরকে বাদ দিয়ে আমরা ভালো সম্পর্ক রাখব। ভালো সম্পর্ক নিশ্চয়ই করার চেষ্টা করব, একাত্তরও থাকবে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জোট সার্ককে সক্রিয় করার কথাও দায়িত্বগ্রহণের পর বলে আসছেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ। এক্ষেত্রে ভারতের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এর জবাবে, সার্ক নিষ্ক্রিয় হওয়ার জন্য পাকিস্তানের কর্মকাণ্ডকে দায় দিয়ে এক্ষেত্রে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত সরকার। উল্টো বাংলাদেশকে বলেছে, ঢাকা যেন ‘সন্ত্রাসবাদকে স্বাভাবিক বিষয়’ করে না ফেলে।
গত বছরের ১১ নভেম্বর পাকিস্তান থেকে পণ্যবাহী জাহাজ সরাসরি বাংলাদেশে আসে। ওই দিন প্রথমবার পানামা পতাকাবাহী জাহাজ ‘ইউয়ান জিয়াং ফা ঝং’ চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য নিয়ে পৌঁছায়। এর আগে পাকিস্তান থেকে পণ্য আসত বিভিন্ন বন্দর ঘুরে। এবার সরাসরি আসছে পণ্যবাহী জাহাজ। ২০২৪ সালের ২২ নভেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি হয়েছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১.৪০ শতাংশ বেশি। আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে করাচির সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। ফলে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বেড়েছে। পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে কনটেইনারবাহী পণ্য কলম্বো, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ বিভিন্ন বন্দর ঘুরে চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে সময় লাগত ২০-২২ দিন। কিন্তু পাকিস্তানের করাচি থেকে চট্টগ্রাম রুটে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় এখন সময় লাগছে মাত্র ১১-১২ দিন। আমদানির বাইরে রপ্তানি নিয়েও ভাবতে হবে: ২০২৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাজস্ব বোর্ডের জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তানের আমদানি পণ্য খালাসে জটিলতা নিরসন করে। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসার সুবিধার্থে পাকিস্তান থেকে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর থেকে বাধ্যতামূলক শতভাগ ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন (কায়িক পরীক্ষা) শর্ত প্রত্যাহার করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই শর্ত প্রত্যাহারের ফলে এখন অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বিবেচনায় যেভাবে পরীক্ষা করা হয়, পাকিস্তান থেকে আমদানির ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নেয়া হবে জানানো হয়। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে শেষ এফওসি ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।