আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি নিয়ে গত বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় পৌনে দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে ‘নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ও সুস্পষ্ট রোডম্যাপ’ পায়নি। আলোচনা ফলপ্রসূ না হলেও আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনে অনড় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। এ নিয়ে হতাশা চেপেও রাখেনি দলটি। ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি গণমাধ্যমকে বলেছে, ‘বৈঠকের ফলাফলে তারা একেবারেই সন্তুষ্ট নয়।’ এ অবস্থায় কী করবে বিএনপি জানতে চাইলে দলীয় মহাসচিব কৌশলে উত্তর এড়িয়ে গেলেও দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারকে অব্যাহত চাপে রাখবে দলটি। সারা দেশে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি দেবে একের পর এক। ইউনিয়ন/পৌরসভা থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলা, মহানগর, বিভাগ পর্যন্ত সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, গণমিছিল, গণঅবস্থানসহ নিয়মতান্ত্রিক নানা কর্মসূচি দেবে বিএনপি। এসব কর্মসূচি চলতি মাসের শেষের দিক থেকে অথবা মে মাসের শুরু থেকে আরম্ভ হতে পারে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি চলতি বছরের জুন-জুলাই মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিল। তখন প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছিলেন। বিএনপি তাতে আশ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু পরে সরকার ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা জানায়। তার পর থেকে বিএনপি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা এবং নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশনা দেয়ার অনুরোধ জানায়। সম্প্রতি নির্বাচন নিয়ে নানামুখী কথা শুরু হলে বিএনপি সরকারের সঙ্গে আবার বসার সিদ্ধান্ত নেয়।
বিএনপির সূত্র জানায়, তাদের পক্ষ থেকে বৈঠকে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে রমজান, তারপর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এবং এর পর বর্ষাকাল শুরুর কথা স্মরণ করিয়ে ডিসেম্বরের পর নির্বাচন করা কঠিন বলে মত দেয়া হয়। জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে তিনি নির্বাচনের তারিখ ঠিক করবেন। কোনোভাবেই জুন পার করবেন না।
বৈঠকে নির্বাচনি রোডম্যাপ, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার, শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বিএনপি একেবারেই সন্তুষ্ট নয়। প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট করে নির্বাচনের সময়সীমার কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন শেষ করতে চান। আমরা তার (প্রধান উপদেষ্টা) বক্তব্যে একেবারেই সন্তুষ্ট নই। আমরা পরিষ্কার করে বলেছি- ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, তা আরও খারাপের দিকে চলে যাবে এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন হবে।’
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং করণীয় নিয়ে একটি লিখিত প্রস্তাবনা প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরা হয়। সেখানে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির ওই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, তারা ফ্যাসিস্ট এবং তাদের দোসরদের বিচার ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার কার্যক্রম দৃশ্যমান না করা পর্যন্ত নির্বাচন দিতে পারছেন না। খুব শিগগির এসব কার্যক্রমকে দৃশ্যমান করার উদ্যোগ ত্বরান্বিত করা হবে বলে আশ্বস্ত করা হয় বিএনপি নেতাদের।
বিএনপি নেতারা বলেছেন, নির্বাচনের জন্য ১৮ মাস যথেষ্ট সময়। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের যে গতি, সংস্কারের যে গতি, তাতে নির্বাচন নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে। যেসব সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য হবে, তার মধ্যে যেসব সংস্কার নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন, সেগুলো দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। বাকিগুলো জুলাই সনদ হিসেবে থাকবে। সেই সনদ বাস্তবায়নের জন্য যারাই ক্ষমতায় আসবে, তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। কিন্তু সংস্কার ও বিচারের দোহাই দিয়ে নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলা উচিত হবে না।
বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা না বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। সেখানে কোনো সমস্যা থাকলে বিএনপি প্রয়োজনে সাহায্যের প্রস্তাব দেয়। তারা ট্রাইব্যুনাল ও প্রসিকিউশন টিমে লোকবল সংকট, যথেষ্ট তদন্ত টিম না থাকায় সময়ক্ষেপণ হচ্ছে বলে জানান।
বৈঠকে অংশ নেয়া বিএনপি প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য বলেছেন, যদি নির্বাচন নিয়ে আরও সময়ক্ষেপণ করা হয় তাহলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টির ঝুঁকি থাকবে। পতিত সরকারের দোসররা সক্রিয় হবে। তারা ষড়যন্ত্রের সুযোগ পাবে। আবার অনির্বাচিত সরকারের লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বিএনপি শুধু নির্বাচনের স্বার্থেই নির্বাচন চায় না; গণতন্ত্রের জন্য, দেশের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে এবং গণঅভ্যুত্থানের যে প্রতিশ্রুতি, তা বাস্তবায়নে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছে।
বিএনপি নেতারা বলেন, দেশের মানুষ বিগত ১৬ বছর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। সেই অধিকার ফিরিয়ে আনতে বিএনপি আন্দোলন করেছে। ফ্যাসিবাদের পতনের পর চলতি বছরের জুন-জুলাই মাসের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছে বিএনপি। কিন্তু যখন প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছেন, তাতেও আশ্বস্ত হয়েছে বিএনপি। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতির সামনে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা এবং নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশনা দেয়ার অনুরোধ জানায় বিএনপি। কিন্তু তার বিপরীতে সরকারের কেউ কেউ নির্বাচন নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। একই সঙ্গে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কথাবার্তায় জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।
ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে কী করবে বিএনপি- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দলের ভেতরে এবং আমাদের মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। তারপর আমরা আবারও আপনাদের সামনে আসব।’
সূত্রমতে, বিএনপি চায় একটি অর্থবহ নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করুক। এতে শেষ পর্যন্ত যদি আরও দুয়েক মাস দেরিও হয়, অর্থাৎ নির্বাচন যদি ডিসেম্বরের পরিবর্তে শেষ পর্যন্ত জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতেও যায় সে পর্যন্ত তারা ধৈর্য ধরতে পারে। তবে সেটি কোনোক্রমেই আগামী মার্চের পরে যেতে পারবে না।
বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতা বলেন, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট আর যে বিষয়গুলো আছে- সেগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলো নিয়ে সব দল ঐকমত্য হবে, সেগুলোর চার্টার (সনদ) করতে রাজি বিএনপি। আর সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে সব রাজনৈতিক দল একমত হলে তারা নির্বাচনের দিকে চলে যেতে পারেন। বাকি যে সংস্কার থাকবে, সেগুলো যে রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হয়ে আসবে, তারা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেবে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। তবে তিনি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করবেন না, তা বলেননি।
এদিকে গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছি। নির্বাচন ডিসেম্বরের আগেও হতে পারে, সেটাও বলেছি।
এখানে সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা নিজে বলেছেন, যেসব বিষয়ে সবার ঐকমত্য থাকবে সেসব বিষয়ে সংস্কার করা হবে। সহজ বিষয়- আমরা সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছি। সবার যেসব বিষয়ে ঐকমত্য আছে আমরা সেটি দিয়েছি। ঐকমত্য হলে সেটা এক মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার সব বিএনপির সময় হয়েছে। আগামী দিনে আমরা আরও বড় ধরনের সংস্কারে যাব।
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশি জনগণের দ্বারাই নির্ধারিত হবে। দেশটি বলেছে, বাংলাদেশ অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে এবং মানুষের কর্মকাণ্ডই ঠিক করবে তারা কীভাবে এই সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করবে। গত মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নকারীর প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস।
নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার জানিয়েছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ আগামী জুলাই মাসে ঘোষণা করা হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে রোডম্যাপের যে বিষয়টি, যে কর্মপরিকল্পনাটি, আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে একটা নিজস্ব কর্মপরিকল্পা ধরেই এগোচ্ছি।