বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমারে রাজনৈতিক ও সামরিক অস্থিরতা কোনোভাবেই পিছু ছাড়ছে না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে এবং তাদের নৃশংস নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্তমানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকার সম্মত থাকলেও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাখাইন রাজ্যের আরাকান আর্মি।
গতকাল শুক্রবার ফরেন সার্ভিস দিবস উপলক্ষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথে বড় সমস্যা আরাকান আর্মি। বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান না হওয়ায় তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় যাওয়া যাচ্ছে না। আবার তাদের এড়িয়েও এ সংকট সমাধান সম্ভব নয়।
জানা গেছে, গত ৪ এপ্রিল ব্যাংককে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে এক বৈঠকে মিয়ানমারের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান শিউ বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমাকে জানান বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের যোগ্য (ভেরিফাই) হিসাবে চিহ্নিত করেছে মিয়ানমার। বৈঠকের এই তথ্য জানান ড. খলিলুর রহমান নিজেই। এরপর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে জানায়, ‘রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের দিকে এটি একটি বড় ও নিশ্চিত পদক্ষেপ।’ তবে, মিয়ানমারে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের যোগ্য হিসাবে চিহ্নিত করলেও রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে কবে ফিরবে তা নিশ্চিত নয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে ২০১৮ সালে আট লাখ ২৯ হাজার ৩৬ জন রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমার সরকারের কাছে দেয়া হয়েছে। ওই তালিকা থেকে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করা হবে, সেটি কবে নাগাদ তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গারা কেন ভীতির কারণ হবে, তা ঠিক জানা নেই, আরাকান আর্মি যদি রোহিঙ্গাদের স্বীকার না করে, তাহলে সমস্যায় পড়বে আরাকান আর্মি। কারণ রোহিঙ্গা বিশাল জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠী নিয়ে মিয়ানমারকে চলতে হবে। সেখানে রোহিঙ্গাদের ভয় করলে চলবে না। তবে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আরাকান আর্মি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, আসলে এটা নির্ভর করছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ওপর। তারা চাইলেই আমরা ফেরত পাঠানোর জন্য প্রস্তুত আছি। আর রোহিঙ্গারাও তাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে চান। কিন্তু যে কারণে তাদের চলে আসতে হয়েছে সেই কারণ যদি বর্তমান থাকে তাহলে সেটা কীভাবে সম্ভব। তারা তো চায় নাগরিক হিসাবে আত্মমর্যাদা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিয়ে সেখানে ফিরতে।
দেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করা রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের মুখে বিতাড়িত করা হয়েছে। আর সেই রাখাইন রাজ্য এখন আরাকান আর্মির দখলে। সেখানে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের আগে আরাকান আর্মির ইতিবাচক মনোভাব দরকার। কারণ রাখাইন অঞ্চল এখন আর মিয়ানমার জান্তার নিয়ন্ত্রণে নেই। ওই অঞ্চলের অধিকাংশ ভূখণ্ড এখন আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণ করছে। এমতাবস্থায় জান্তাগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের কোথায় পুনর্বাসন করবে, তা নিয়ে আছে ধোঁয়াশা। আরাকান আর্মিকে পাশ কাটিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়।
জানা গেছে, রাখাইনের যেসব এলাকায় রোহিঙ্গাদের বসতি, সেগুলো এখন আরাকান আর্মির দখলে। রাখাইনের জনসংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। সেখানকার মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বৌদ্ধ এবং ৩৫ শতাংশ মুসলিম রোহিঙ্গা। জনসংখ্যার বিচারে রোহিঙ্গাদের অবস্থান নেহাত কম নয়। তারপরও কথা থেকে যায়। কয়েক বছর ধরে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মিয়ানমার জান্তা কৌশলে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করেছে। ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর আরাকান আর্মির ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। এই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নেতাদের একজন মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, বাংলাদেশ সরকার আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছে। এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা ভেরিফাই করতে মিয়ানমারের আট বছর লেগেছে। রোহিঙ্গা আছে ১২ লাখ। সবাইকে ভেরিফাই করতে হলে ৪০ বছর লাগবে। আর ভেরিফাই করার প্রশ্ন কেন। আমরা তো রোহিঙ্গা, মিয়ানমারের নাগরিক। আমরা পূর্ণ নিরাপত্তা নিয়ে নাগরিক হিসাবে আমাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে চাই। সেখানে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে সেফ জোন করে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, মিয়ানমার জান্তার এই ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নতুন প্রতারণা শুরু করেছে।
রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, আসলে মিয়ানমারের জান্তাদের কিছু কৌশল আছে। জান্তাদের বিরুদ্ধে জোনোসাইডের অভিযোগ আছে। তারা একটা কৌশল নিচ্ছে। এর আগে তারা ভেরিফিকেশনের কথা বলেছে। আসলে দরকার রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে সম্মানজনক প্রত্যাবাসন করা।
মিয়ানমারের সিতোয়ে মিশনে বাংলাদেশের সাবেক হেড অব মিশন মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আর এখন প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা আরাকান আর্মির দখলে। মিয়ানমার জান্তা আসলে নতুন কৌশল নিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়া নয়। আর আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মিয়ানমারের হয়ে কিছু রোহিঙ্গা যুদ্ধ করেছে। সেটাকে আরকান আর্মি কীভাবে নেবে সেটাও একটা প্রশ্ন। রাখাইনে তো আর মিয়ানমার জান্তার এখন দখল নেই।
গত মার্চে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তিনি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস কক্সবাজারে এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করেন। তখন রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফেরার দাবি জানিয়ে বেশ কিছু প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। ওই অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যেতে চান, তাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকার এর আগেও ঘোষণা দিয়েছিল কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানে রাখাইন রাজ্য মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সুতরাং আরাকান আর্মি যতদিন রয়েছে, ততদিন এক লাখ ৮০ হাজার নিতে চাওয়া বা তিন লাখ নিতে চাওয়া, এটা পুরোপুরি অর্থহীন।