বিগত আওয়ামী লীগ আমলে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তার অধিকাংশের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ ওঠে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তৎকালীন বহু জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী অফিসাদের (ইউএনও) বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রশাসন বিএনপির হয়ে কাজ করতে পারে এমন অভিযোগ তুলেছে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। এনসিপির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি বলছে, প্রশাসনের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধীদের সখ্যতা সবচেয়ে বেশি।
জানা গেছে, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে সর্বোচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন রিটার্নিং অফিসার। এছাড়াও ডিসি, পুলিশ সুপার, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, ইউএনও, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তা ও সদস্য, আনসার, প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসাররা নির্বাচনের দায়িত্বে থাকেন। কাগজপত্রে জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা জাতীয় নির্বাচনের দায়িত্বে সরাসরি না থাকলেও নির্বাচনে ও রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করেন। মেট্রোপলিটন এলাকার কিছু আসনে তারা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাও হন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সংসদ কিংবা স্থানীয় নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকে পুলিশ, ডিসি, ইউএনও এবং নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। কিন্তু বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এসব কর্মকর্তা নির্বাচনি এলাকায় দায়িত্বে গাফিলতি ছিল। বেশিরভাগ কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিতে কাজ করেন, এজন্য তারা পদোন্নতি ও বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান। আগামী সংসদ নির্বাচনে এসব কর্মকর্তা কেমন ভূমিকা রাখবেন, তা নিয়ে আগেভাগে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে বিএনপি-এনসিপি। বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিক্রিয়াগুলো তুলে ধরার চেষ্টা চলছে। কারণ ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন নিয়ে তুমুল সমালোচনা রয়েছে। এসব নির্বাচন একতরফা এবং অনিয়মের মাধ্যমে সরকার গঠন হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। একতরফাভাবে নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। অভিযোগ আছে, এই নির্বাচনে বিপুল কারচুপি হয়েছে, নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট ভরে রাখা হয় বক্সে।
গত বুধবার ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সঙ্গে বৈঠক শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রশাসন অনেক জায়গায় বিএনপির পক্ষে কাজ করছে, এ ধরনের প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কোনো ধরনের ন্যূনতম সংস্কার নয়, মৌলিক সংস্কার নিয়ে এনসিপি কাজ করছে। আমরা এখানে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, গুণগত পরিবর্তনের জন্য কাজ করছি। কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচনের দিকে গেলে সে নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হবে না এবং সে নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টি অংশগ্রহণ করবে কি না, সেটাও বিবেচনাধীন থাকবে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, বর্তমান সময়ে যে মাঠ প্রশাসন রয়েছে, সেই মাঠ প্রশাসন আমাদের কাছে মনে হয়েছে নিরপেক্ষ আচরণ করছে না। বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চলছে, সেই জায়গায় প্রশাসনকে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করতে দেখছি, সেই জায়গাগুলো আমরা বলেছি।
প্রশাসন নিরপেক্ষ না হয়ে কার পক্ষ নিচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে নাহিদ বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করছি প্রশাসন আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ অবলম্বন করছে। অনেক জায়গায় এবং মাঠপর্যায়ে যে ধরনের চাঁদাবাজি চলছে, সেই জায়গায়ও মাঠ প্রশাসন আসলে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে। আমরা বলেছি, যদি এ ধরনের একটা প্রশাসন থাকে, তাহলে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন, আমলাতন্ত্র এবং পুলিশ আমাদের ঠিক করতে হবে।’
প্রশাসন বিএনপির পক্ষ অবলম্বন করছে এনসিপির এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই বক্তব্য দেয়া হয়েছে। প্রশাসনের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধীদের সখ্য সবচেয়ে বেশি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিএনপি সমর্থকরা জায়গা করে নিয়েছে। এতে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এক ধরনের সহযোগিতা পেতে পারে বলে মনে করছে এনসিপির নেতারা। নাহিদের এমন বক্তব্য সমর্থন দিয়ে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, পরবর্তীতে ক্ষমতায় কে আসবে, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র সে অনুযায়ী কাজ করে। এরা (আমলারা) সবসময় একটি আশ্রয়ে থাকতে চায়। আওয়ামী লীগ আমলাদের এতদিন ধরে আশ্রয় দিয়েছে। তাই আমলারা আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করে গেছে বলেও উল্লেখ করেন এনসিপির ওই নেতা।
তিনি আরও বলেন, বড় দল হিসাবে পরবর্তীতে বিএনপিরই ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা আছে। তাই, প্রশাসন দেখল যে সরকার দ্রুত নির্বাচন দিলে ক্ষমতায় আসবে বিএনপি। সে কারণে বিএনপির সঙ্গে তারা এক ধরনের দর কষাকষির মাঝে গেছে। প্রশাসন বিএনপির প্রতি নমনীয় আচরণ শুরু করেছে।
বিএনপির প্রতি প্রশাসনের পাক্ষপাতিত্বের যে অভিযোগ তুলেছেন নাহিদ ইসলাম, সেটাকে ‘পলিটিক্যাল রেটরিক’ বা ‘রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর’ হিসেবে বর্ণনা করছে বিএনপি। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, নাহিদ ইসলাম ‘সঠিক কথা বলেননি।’ যা বলেছেন, তা মানুষকে ‘বিভ্রান্ত’ করার জন্য। এনসিপির সঙ্গে প্রশাসনের সখ্য রয়েছে। তিনি বলেন, কোনো দেশে যারা সরকারে থাকে, প্রশাসন বা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন হয় তাদের নামে। যেমন, ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি ইউনূস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। সেক্ষেত্রে আমরা যতটুকু জানি, বাংলাদেশের প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্রদের তথা বৈষম্যবিরোধীদের সখ্য সবচেয়ে বেশি। তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে নজরদারি করে। এখন এটা বিএনপির প্রশাসন হলো কী করে?
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারি কর্মকর্তাদের ভূমিকার বিষয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে সরকারি কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যে কোনো নির্বাচনে সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করা উচিত নয়। তাদের নিরপেক্ষভাবে আচরণ করতে হবে, এটাই কাম্য।