আগামী ডিসেম্বর ও জুন সামনে রেখে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই টার্গেট নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতসহ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রার্থীর তালিকা প্রায় চূড়ান্ত করেছে। নির্বাচনি আসনে প্রার্থীদের নিয়ে গণসংযোগে নামছে তৃণমূল নেতাকর্মীরা। এসবের মধ্যেই জামায়াতের নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পাওয়া নিয়ে আশা-নিরাশার দোলায় দুলছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৃণমূল কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের আমলে জামায়াতের নেতাকর্মীর ওপর মামলা, জেল, জুলুম, হত্যাসহ অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতা থেকে মাঠপর্যায়ের কর্মীরা নিজ বাড়িতে আতঙ্কে ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গিয়ে জামায়াতের কর্মীরা প্রাণ দিয়েছেন। এরপরও গত আট মাসে দলের নিবন্ধন ফিরে পাওয়া নিয়ে জটিলতা কাটছে না। কারণ বিচার বিভাগ এখনও ফ্যাসিবাদমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। জামায়াতে ইসলামী যেন নিবন্ধন ফিরে না পায়, সেজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের দোসররা। অন্যদিকে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার তৈরি কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রশ্নবিদ্ধ মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনা বা রিভিউ চেয়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবিতে দলটি আন্দোলন করলেও কোনো সুরাহা হয়নি। কেন্দ্রীয় নেতাদের দূরদর্শী সিদ্ধান্তের অভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু দুটি ঝুলে আছে। যার কারণে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভেতরে এক ধরনের হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। তবে, দলটির নিবন্ধন নিয়ে হতাশ না হতে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানান জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির। তিনি বলেন, শিগগিরই দলটি নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পেতে যাচ্ছে। অন্যদিকে, জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলামের মুক্তির বিষয়টিও চলতি মাসেই ফয়সালা হবে। গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলেন শিশির মনির। তিনি আরও বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন মামলাটি একটা সার্টিফিকেটের আপিল। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে সার্টিফিকেটের আপিল হয়েছে। এই সার্টিফিকেটের আপিল মানেই সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত। যেহেতু সার্টিফিকেটের আপিল। তাই সার্টিফিকেটের আপিলটা পূর্ণাঙ্গভাবে শুনানি হওয়া প্রয়োজন। পূর্ণাঙ্গ শুনানি শুরু হয়েছে। আপিল মামলার শুনানিগুলো মঙ্গল ও বুধবার অনুষ্ঠিত হয়। সুতরাং আগামী ২২ ও ২৩ এপ্রিল মামলার শুনানি শুরু হবে এবং দ্রুত শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করেন জামায়াতের এই আইনজীবী।
গতকাল রোববার আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পোস্টে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের আপিল শুনানি আগামী ২২ এপ্রিল প্রধান বিচারপতির আদালতে উপস্থাপন করা হবে। ফেসবুক পোস্টে শিশির মনির লিখেছেন, ‘এটিএম আজহারুল ইসলাম ভাইয়ের মামলার সব প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ফৌজদারি আপিল নং ৩৮/২০২৫। ২১ এপ্রিল মাননীয় প্রধান বিচারপতির আদালতে ২২ এপ্রিল শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হবে। আশাকরি দ্রুতই নিষ্পত্তি হবে।’
জানা গেছে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটের প্রস্তুতি নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। পিছিয়ে নেই জামায়াতও। এরই মধ্যে প্রায় ৩০০ আসনে প্রার্থীও চূড়ান্ত করেছে দলটি। অথচ নিবন্ধন এবং প্রতীকের বিষয়টি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি সর্বোচ্চ আদালতে। অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, যৌক্তিক কারণে বিলম্ব হলেও হতাশ হওয়ার কারণ নেই। শিগগিরই নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পাওয়ার মামলার চূড়ান্ত রায় হবে। তিনি বলেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর আইনি প্রক্রিয়ায় অন্যদলের শীর্ষ নেতারা মুক্ত হলেও একযুগের বেশি সময় ধরে কারাগারে এটিএম আজহার। সেটি নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে দলটির ভেতরে-বাইরে। তবে মুক্তির আইনি প্রক্রিয়া শেষ। এখন শুধু শুনানির অপেক্ষা।
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট সুপ্রিমকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেন। ফলে বিগত সংসদ নির্বাচনে দলটি অংশ নিতে পারেনি। কারণ, দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে হলে দলের নিবন্ধন প্রয়োজন। গত ৫ আগস্টের পর জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন ফেরত না পাওয়া নিয়ে নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। দলটির নেতারা আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন এবং সেই লড়াইয়ে জয়ী হয়ে শিগগিরই নিবন্ধন ফিরে পাবেন।
এ বিষয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, জামায়াতে ইসলামী ১৯৭৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। এ পর্যন্ত জামায়াতের ৫৫ জন সংসদ সদস্য প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সেখানে দলের নিবন্ধন ফিরিয়ে পেতে দেরি হওয়ায় আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে বেদনার। আশাকরি আমরা ন্যায়বিচার পাব। আমরা মনে করি এটা আইন এবং সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তিনি আরও বলেন, জামায়াতে ইসলামী তো এ দেশের মানুষের সমর্থন নিয়ে রাজেনৈতিক দল হিসেবে কাজ করছেন। অবশ্যই এসব বিষয় আদালতের সামনে আছে। আমরা আশাকরি আইনানুগ পন্থায় আমাদের অধিকার ফিরে পাব।
গাইবান্ধা সাঘাটা উপজেলার জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক সেক্রেটারি ও সহকারী অধ্যাপক মো. এনামুল হক সরকার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পেতে যথেষ্ট সোচ্চার তৃণমূল নেতাকর্মীরা। স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় সভা-সেমিনারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে বার্তাও দেয়া হচ্ছে। কিন্তু গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতাদের সরলতাকে দুর্বলতা ভাবছে প্রশাসন। সেজন্য ফ্যাসিস্ট বিদায়ের আট মাস পরেও জামায়াতের নিবন্ধন ফিরে পাওয়া এবং জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতারা রাজপথ ও আইনি লড়াইয়ে সমস্যা সমাধানে তৃণমূলকে আশ্বস্ত করেছেন।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন (বর্তমানে অবসর), বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (পরে আপিল বিভাগের বিচারপতি হয়ে ৫ আগস্টের পর পদত্যাগ) ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের (১৯ নভেম্বর পদত্যাগ করেন) সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ। সে সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলেন, এ নিবন্ধন দেওয়া আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত। একইসঙ্গে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে ওই রায়ের বিষয়ে আপিল করারও অনুমোদন দিয়ে দেন। তবে এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। পরে একই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে।
পরে ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের ওই আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এদিন আদালতে রিটকারীদের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানিয়া আমীর ও আহসানুল করীম। জামায়াতে ইসলামীর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলীর (পরে প্রয়াত) পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. জিয়াউর রহমান। ওইদিন আইনজীবী জিয়াউর রহমান বলেন, আমাদের সিনিয়র আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলীর ব্যক্তিগত অসুবিধা ছিল। আর অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীনও অনুপস্থিত ছিলেন। এই ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে ছয় সপ্তাহ সময় চেয়েছিলাম।
যেহেতু আমাদের আইনজীবীরা উপস্থিত নেই, সেহেতু আদালত এটা ‘ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ করেছেন। অর্থাৎ আইনজীবী উপস্থিত না থাকার কারণে খারিজ করেছেন। পরবর্তী সময়ে আইনি সুযোগ কী আছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রিস্টোর (পুনরায় শুনানির জন্য) আবেদনের সুযোগ আছে। সে ক্ষেত্রে এটা আদালতের এখতিয়ার। এরপর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ফের আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। গত জুলাই মাস থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা কোটা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে। এ আন্দোলনে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে ছাত্র-জনতা সরকার পদত্যাগের দাবি তোলে। এর মধ্যে ১ আগস্ট সরকার অঙ্গসংগঠনসহ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধের আবেদন বাতিলের উদ্যোগ নেয়। গত ২৮ আগস্ট সরকার আগের নিষিদ্ধের আদেশ বাতিল করে। এরপর আপিল বিভাগে নিবন্ধন মামলাটি পুনরায় শুনানির জন্য আবেদন করে জামায়াতে ইসলামী। গত ২২ অক্টোবর আদালত বিলম্ব মার্জনা করে আপিলটি শুনানির জন্য রিস্টোর করেছেন। অর্থাৎ পুনরুজ্জীবিত করেছেন। পরে ৩ ডিসেম্বর থেকে শুনানি শুরু হয়। এর মধ্যে একজন বিচারপতি অসুস্থ থাকায় মামলাটি আর শুনানি হয়নি। আদালতে জামায়াতের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক ও আইনজীবী শিশির মনির। ইসির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম।