ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপির তৃতীয় বৈঠক

তাড়াহুড়া নয়, সাংবিধানিক উপায়ে সংস্কার চায় বিএনপি

* একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান, দলপ্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না- এমন প্রস্তাবে বিএনপি একমত নয় * বিরতি দিয়ে এক ব্যক্তি তিনবার প্রধানমন্ত্রী থাকার পক্ষে দলটি * আপিল বিভাগের সবচেয়ে সিনিয়র তিন বিচারপতির মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ চান তারা
তাড়াহুড়া নয়, সাংবিধানিক উপায়ে সংস্কার চায় বিএনপি

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংবিধান ও রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে তৃতীয় দিনের মতো বৈঠক করেছে বিএনপি। এই আলোচনায় দলটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের অনড় অবস্থান স্পষ্ট করেছে। প্রথমত, একই ব্যক্তি একযোগে সরকারপ্রধান, দলপ্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না- এই প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। দ্বিতীয়ত, কেউ টানা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না- এই প্রস্তাবেও তারা একমত নয়। তবে বিএনপি জানিয়েছে, কেউ যদি টানা দুইবার প্রধানমন্ত্রী থাকেন, তাহলে এক বছর বিরতির পর আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। দলটির ভাষ্য- তাড়াহুড়া নয়, সাংবিধানিক উপায়ে সংস্কার চায় তারা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, আমরা আলোচনাটি দ্রুততার সঙ্গে যাচ্ছি না এজন্য যে, এটা রাষ্ট্রের-প্রজাতন্ত্রের বিষয়। সংবিধানের বিষয়- তাড়াহুড়োর কিছু নেই। তিনি বলেন, যেসব সিদ্ধান্ত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে গৃহীত হলে, বড় পরিসরে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে, জাতীয় জীবনে মহান ভূমিকা রাখবে, সেসব বিষয়ে একটু সময় বেশি নিলেও বিস্তারিত রিপোর্টের উপর আলোচনা করছি।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রদত্ত স্প্রেডশিট নিয়ে আমরা আলোচনা করিনি। এটা নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। যেটা নিয়ে ওনারা আলোচনা করতে আগ্রহী হয়নি, আমরাও আগ্রহী হইনি। আমরা বিস্তারিত রিপোর্টের উপর দফায় দফায় আলোচনা করছি। বিএনপি বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্টের একটা সচিবালয় গঠন করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল, এটাসহ বিচারবিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতায় আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে, আমি বিচারবিভাগের সব উদ্যোগ আইনানুগ ও সাংবিধানিক হয়, সেই আহ্বান জানাব। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য আরও জানান, প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকার, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন প্রভৃতির সংস্কার, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এসিসি), নির্বাচনব্যবস্থা, নির্বাহী বিভাগ, সংবিধান সংস্কার প্রভৃতি বিষয়ে গত দুই দিন কমিশনের সঙ্গে তাদের আলোচনা হয়েছে।

একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান, দলপ্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না- ঐকমত্য কমিশন এই প্রস্তাবে বিএনপি একমত নয় বলেও জানিয়েছেন সালাউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি উন্মুক্ত রাখতে প্রস্তাব দিয়েছি। তিনি বলেন, একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান ও দলীয়প্রধান হতে পারবেন না- এমন চর্চা আমরা দেখি না। যুক্তরাজ্যেও আমরা দেখি, পার্টি প্রধানকে সরকারপ্রধান। এটি গণতান্ত্রিক চর্চা। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রচলন হয় এবং নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রচলন করা যায়, তাহলে সেই ভোটে যারা ক্ষমতায় আসবে, মনে করতে হবে জনগণ তাদের সেই ক্ষমতা দিয়েছে।

বিএনপি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব করেছে জানিয়ে সালাউদ্দিন বলেন, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ বা বহুত্ববাদ কোনোটাই নেই। তবে কমিশন তাদের প্রস্তাবে- স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে থাকা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের কথা যুক্ত করতে বলেছে। আমরা সেখানে একমত হয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী পদে টানা দুই মেয়াদের বেশি কেউ থাকতে পারবেন না- ঐকমত্য কমিশনের এমন প্রস্তাবে ভিন্নমত জানিয়েছে বিএনপি। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা প্রস্তাব করেছি, প্রধানমন্ত্রী পদে টানা দুই মেয়াদের বেশি কেউ থাকতে না পারলেও একবার বিরতি দিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলে সেই সুযোগ থাকতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের মধ্যাহ্নভোজ বিরতিতে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।

সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, বিএনপির এই প্রস্তাবের পর ঐকমত্য কমিশন থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদে একব্যক্তির একাধিকবার থাকা নিয়ে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সেটা তারা এখনি প্রকাশ্যে আনতে চান না। আগে কমিশনের সেই প্রস্তাব নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করবেন।

বিএনপি রাষ্ট্রপতির কিছু ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছে। তবে তারা মনে করে, সবকিছু সংবিধানে ঢোকানোর বদলে নতুন আইন করে বাস্তবায়ন করাই ভালো হবে। কারণ ভবিষ্যতে পরিবর্তন দরকার হলে সংবিধান সংশোধন কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সংসদে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ গঠনের বিষয়ে বিএনপি একমত হলেও সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা এখনও চলছে।

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবেও বিএনপি দ্বিমত পোষণ করেছে। দলটির মতে- এমন কাউন্সিল গঠিত হলে প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্র পরিচালনায় সমস্যায় পড়তে হবে। এছাড়া বিএনপি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার পক্ষে। তবে তারা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে থাকা সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার এই তিনটি মূলনীতি সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে একমত হয়েছে।

বিএনপি সংবিধানে ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে। তবে তাদের মতে, রাষ্ট্রের আর্থিক সক্ষমতা ও বাস্তবতা বিবেচনা করে মৌলিক অধিকার নির্ধারণ করা উচিত। সংসদ সদস্যদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে দলটি চারটি বিষয় ছাড়া সব বিষয়ে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। চারটি বিষয় হলো- অর্থবিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধনী এবং জাতীয় নিরাপত্তা। এসব বিষয়ে এমপিরা দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে চলবেন, তবে অন্যান্য বিষয়ে স্বাধীন মত দিতে পারবেন।

নারীদের জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করার প্রস্তাবে বিএনপি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে সংসদে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও স্বশাসিত করার বিষয়ে বিএনপি নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তারা মনে করে, এসব বিষয়ে সংবিধানে না রেখে আইন করে বাস্তবায়ন করা উচিত। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশনসহ সব স্তরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য কার্যকর আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথাও তারা বলেছে।

বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার পক্ষে মত দিয়েছে। তারা চায় এই বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হোক। এছাড়া সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন নিয়ে বিএনপি প্রস্তাব দিয়েছে, চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদে বাকি সব বিষয়ে সংসদ সদস্যরা যেন স্বাধীনভাবে ভোট ও মত দিতে পারেন। এসব চারটি বিষয় অর্থবিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধনী ও জাতীয় নিরাপত্তা।

রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবে বিএনপি একমত নয়। তারা বলেছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামটি ৫৪ বছর ধরে জনগণ ব্যবহার করে আসছে। এটি একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নাম, যার অর্থ জনগণের শাসনব্যবস্থা। এটি কোনো রাজতন্ত্রবিরোধী শব্দ নয়। বরং জনগণের প্রতিনিধিরাই সংসদে এসে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করেন এবং আইন তৈরি করেন- এটাই গণতান্ত্রিক রীতি।

বিএনপি জানিয়েছে, তারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগকে গুরুত্বসহকারে দেখছে এবং আন্তরিকভাবে আলোচনায় অংশ নিচ্ছে।

সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ অন্তত দুই থেকে তিনজন বিচারপতির মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সুযোগ রাখার পক্ষে বিএনপি। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, রাষ্ট্রপতির অভিশংসনপ্রক্রিয়ায় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটের বিষয়ে বিএনপি একমত পোষণ করেছে। ন?্যায়পাল নিয়োগের বিষয়েও একমত হয়েছে বিএনপি। তবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ তিন বিচারপতির মধ?্য থেকে একজনকে নিয়োগের বাধ্যবাধকতা করা যেতে পারে বলে তারা মতামত দিয়েছে।

সংস্কার কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশের সঙ্গে বিএনপি একমত- এ কথা জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সংবিধানের অষ্টম, নবম, দশম, দ্বাদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বের অবস্থার কথা বলেছে তারা। ধর্মনিরপেক্ষতা বিলুপ্ত করার সঙ্গে বিএনপি একমত। সাম?্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার আনার ক্ষেত্রেও তারা একমত। এগুলো মৌলিক অধিকারে আনার কথা বলেছে বিএনপি।

প্রসঙ্গত, গতকাল সালাহউদ্দিন আহমদের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাঈল জবিউল্লাহ, আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল ও সাবেক সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। আলোচনায় সভাপতিত্ব করছেন ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। বৈঠকে রয়েছেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার। সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর অংশ হিসেবে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা চলছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত