কাতারের রাজধানী দোহায় আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ বক্তা হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আর্থনা সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘আমরা পৃথিবীর জন্য আশার এক বাতিঘর হিসেবে দাঁড়াতে চাই এবং আমাদের বন্ধু ও অংশীদারদের আহ্বান জানাই অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক চুক্তি পুনর্লিখনের জন্য, পাশাপাশি সামাজিক ব্যবসা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং মাইক্রোফাইন্যান্সের ভূমিকা অন্বেষণ করতে, যা প্রান্তিক জনগণের জন্য টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টিতে সহায়ক।’
গতকাল মঙ্গলবার ‘আর্থনা সামিট-২৫’-এর সম্মলনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন এমন এক অবস্থায় দাঁড়িয়ে, যেখানে একটি নতুন সামাজিক চুক্তি করার সুযোগ এসেছে। এটি এমন এক চুক্তি যেখানে রাষ্ট্র ও জনগণ, বিশেষ করে যুবসমাজ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা, ঐতিহ্য, ন্যায়বিচার, মর্যাদা এবং সুযোগের ভিত্তিতে একটি ভবিষ্যৎ একত্রে গড়ে তুলবে। এটি এমন এক সামাজিক চুক্তি যেখানে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও প্রান্তিক জনগণের ক্ষমতায়ন মৌলিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে একটি সহনশীল, সমৃদ্ধ এবং টেকসই ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘তবে এখন এমন নানা হুমকি রয়েছে যা আমাদের উন্নয়নকে বিপথে ঠেলে দিতে পারে। আমরা এমন এক সময় পার করছি যেখানে বহুপাক্ষিকতা হুমকির মুখে, জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুততর হচ্ছে, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে এবং মানবিক সংকট গভীরতর হচ্ছে। নতুন নতুন নীতিমালা, প্রযুক্তি এবং শাসন পদ্ধতি আমাদের পৃথিবীকে দ্রুত রূপান্তরিত করছে, যা অতীতের অনেক অনুমানকে অচল করে দিচ্ছে।’ এমন প্রেক্ষাপটে সহযোগিতা বাড়ানোর উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতার পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। আসুন আমরা সাহসী হই। একটি এমন পৃথিবী গড়ি, যেখানে কেউ এতটা দরিদ্র না হয় যে সে স্বপ্ন দেখতে না পারে, এবং কোনো স্বপ্ন এত বড় না হয় যে তা অর্জন করা যায় না। ভবিষ্যৎ এমন কিছু নয় যা আমরা উত্তরাধিকার হিসেবে পাই। এটি এমন কিছু যা আমরা তৈরি করি। এবং আমাদের প্রত্যেকেরই এতে একটি করে ভূমিকা রয়েছে।’
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের উদ্ভাবন, সহমর্মিতা এবং সম্মিলিত কর্মকাণ্ডের সক্ষমতাও ব্যাপক। কাতার যেভাবে আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের উদ্যোগ নিয়েছে, তা দেখাচ্ছে কীভাবে একটি দেশ উদ্ভাবন, ঐতিহ্য ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে জলবায়ু সংকট, সামাজিক বৈষম্য এবং কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ মোকাবিলা করতে পারে। অধ্যাপক ইউনূস তার মূল বক্তব্যে সামাজিক ব্যবসা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং মাইক্রোফাইন্যান্সের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরির ওপর গুরুত্ব দেন।
ফিলিস্তিনি ও রোহিঙ্গা ইস্যু : কাতারের দোহায় আর্থনা সামিটে মূল বক্তব্য উপস্থাপনকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আজকের সংকটপ্রবণ বিশ্বে যুদ্ধ ও সংঘাত অধিকার খর্ব করে এবং অর্থনীতিকে ব্যাহত করে। তিনি বলেন, ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা যে কোনো অর্থবহ ও টেকসই উন্নয়নের মৌলিক পূর্বশর্ত। ফিলিস্তিন থেকে শুরু করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা পর্যন্ত যে মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে, তা বিশ্বের উপেক্ষা করা উচিত নয়। বিচারহীনতা এবং মানবাধিকারের প্রতি নির্লজ্জ অবজ্ঞা বিশ্বের যে কোনো জায়গায় উন্নয়নের জন্য হুমকি। ফিলিস্তিনে চলমান দুর্দশা কেবল একটি অঞ্চলকে নয়, পুরো মানবতাকে উদ্বিগ্ন করে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যদিও আমরা সবার জন্য একটি স্থিতিস্থাপক, সমৃদ্ধ এবং টেকসই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, তবে বিভিন্ন হুমকি রয়েছে- যা আমাদের ভবিষ্যতের উন্নয়নকে লাইনচ্যুত করতে পারে। আমরা গভীর অনিশ্চয়তার সময়ে বাস করছি, যেখানে বহুপাক্ষিকতা মারাত্মক হুমকির মুখে, জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত হচ্ছে, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে এবং মানবিক সংকট গভীর হচ্ছে। উদীয়মান নিয়ম, প্রযুক্তি এবং শাসন মডেলগুলো আমাদের বিশ্বকে দ্রুত নতুন আকার দিচ্ছে, অতীতের অনেক অনুমানকে অপ্রচলিত করে তুলছে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতার নবায়নযোগ্যতার তাগিদ কখনও এতটা ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের দীর্ঘস্থায়ী সংকট আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে- যার কারণে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উল্লেখযোগ্য ক্ষতি রয়েছে। সংহতির নিদর্শন হিসেবে সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। বৈশ্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বিশ্বনেতাদের অবশ্যই একত্রিত হতে হবে।’
কাতার ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারপারসনের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক : গতকাল মঙ্গলবার কাতারের দোহায় আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা কাতার ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারপারসন শেখ থানি বিন হামাদ বিন খলিফা আল-থানির সঙ্গে বৈঠক করেন। এছাড়াও কাতার চ্যারিটির আন্তর্জাতিক অপারেশন্স সেক্টরের সহকারীপ্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নওয়াফ আবদুল্লাহ আল হাম্মাদির সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে জীবন বদলে ফেলার ওপর জোর : ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে কীভাবে জীবন বদলে দেয়া সম্ভব সেই গল্প কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনে শোনালেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বে ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে জীবন বদলে ফেলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন বদলে ফেলার গল্প শুনিয়েছেন।’ শফিকুল আলম আরও বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার কাতার থেকে আমদানিকৃত এলএনজি আমদানি ব্যয়ের শত শত মিলিয়ন মার্কিন ডলার দীর্ঘদিন পরিশোধ করেনি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই দেনা পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে এবং ২/১ দিনের মধ্যে সব দেনা পরিশোধ করা হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এরইমধ্যে কাতার থেকে আমদানিকৃত এলএনজির দেনার বড় অংশ পরিশোধ করেছে। কাতার থেকে এলএনজি আমদানির ৩৭ মিলিয়ন ডলার এখনও পরিশোধ হয়নি, যা আগামী ২/১ দিনের মধ্যে পরিশোধ করবে সরকার।
বাংলাদেশ থেকে ৭২৫ জন সৈন্য নেবে কাতার : কুয়েতের মতো কাতারও বাংলাদেশ থেকে সৈন্য নেবে। কাতারের দোহায় আর্থনা সামিটের সাইডলাইনে হওয়া বৈঠকে এ কথা কাতার সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। শফিকুল আলম বলেন, গালফ যুদ্ধের সময় থেকেই কুয়েতে আমাদের সৈন্যরা (বাংলাদেশের) দায়িত্ব পালন করছেন। কাতার আমাদের জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ৭২৫ জন সৈন্য নেবে কাতার। স্থায়ীভাবে প্রতি ৩ বছর পরপর একটা ব্যাচ আসবে। আমরা চাইছি যেন এই সংখ্যা বাড়িয়ে ১৬০০ বা আরও বেশি যাতে করা যায়। আমাদের সামরিক সচিব এবং এসএসএফ প্রধান আমাকে গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্য জানান। তিনি আরও বলেন, এখানে একজন সৈন্যের প্রারম্ভিক বেতন আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকার মতো। আমরা আশা করি, দুই মাসের মধ্যে পাঠাতে পারব। এছাড়া আরও ইস্যু আছে, আমরা কাতারে আরও বেশি শ্রমিক পাঠাতে চাই। আরেকটা বড় মিটিং আছে কাতারের জ্বালানিমন্ত্রীর সঙ্গে। কাতার হচ্ছে পৃথিবীতে এলএনজির জন্য এক নম্বর দেশ। কাতারের সঙ্গে আমাদের একটা চুক্তি আছে। এটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি কিন্তু আমরা চাইছি আরও অনেক বেশি এলএনজি আমদানি করতে। কারণ প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগকারী আমাদের জানাচ্ছে যে, তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায়। দেশে থাকা ৬০০ প্রতিষ্ঠানই নতুন সংযোগের জন্য আবেদন করেছে। আমাদের নিজস্ব গ্যাস তো কমছে। সরকার কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও সুন্দর করতে চাইছে, যাতে করে এলএনজি আরও ভালো মূল্যে পাওয়া যায়, জানান শফিকুল আলম।
কাতার আমিরের মায়ের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক : দোহায় আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে কাতারের আমিরের মা ও কাতার ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন শেখ মোজা বিনতে নাসেরের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভাইস চেয়ারপারসন ও সিইও শেখ হিন্দ বিনতে হামাদ আল থানিকে সময়োপযোগী ও চমৎকার এই শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানান ড. ইউনূস। গতকাল দোহায় দুই দিনব্যাপী আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘আমাদের উত্তরাধিকার গড়ে তোলা: স্থায়িত্ব, উদ্ভাবন ও ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান’। আর্থনা সম্মেলন এমন একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে, যেখানে ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান ও উদ্ভাবনী পন্থাগুলো আধুনিক টেকসই উন্নয়নে কীভাবে অবদান রাখতে পারে, তা অনুসন্ধান করা হয়, যা একটি আরও সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশি চার নারী ক্রীড়াবিদকে সংবর্ধনা জানাল কাতার : আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের আগে বাংলাদেশের চার নারী ক্রীড়াবিদকে কাতারের ম্যান্দারিন ওরিয়েন্টাল হোটেলে কাতার ফাউন্ডেশনের নেতৃত্বে সংবর্ধনা জানানো হয়। এই চার ক্রীড়াবিদ হলেন- ফুটবলার আফিদা খন্দকার ও শাহেদা আখতার রিপা এবং ক্রিকেটার সুমাইয়া আখতার ও শারমিন সুলতানা।
প্রসঙ্গত, আর্থনা সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে গত সোমবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে রওনা দেন অধ্যাপক ড. ইউনূস। বিমানটি সোমবার (দোহার সময়) রাত ৯টা ৪০ মিনিটে হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালে ড. ইউনূসকে স্বাগত জানান কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নজরুল ইসলাম।
