খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) সিন্ডিকেট ৩৭ জন শিক্ষার্থীর সাময়িক বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করলেও আন্দোলনে অনড় থাকছেন কুয়েট শিক্ষার্থীরা। ভিসি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন। দাবি আদায়ে গতকাল বুধবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় কফিন মিছিল করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সামনে থেকে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্বার বাংলার পাদদেশে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। ভিসির পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শনে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দেন- ‘আমার ভাই মরছে ভিসি কেন হাসছে?’ ‘আমার ভাই শয্যায় ভিসি কেন ক্ষমতায়?’ ‘দেখ ভিসি চোখ খুলে আমরা গুটিকয়েক নারে, কুয়েটিয়ানরা দিচ্ছে ডাক দালাল ভিসি নিপাত যাক’, ‘গদি ধরে মারো টান মাসুদ হবে খান খান’, ‘এক-দুই-তিন-চার ভিসি তুই গদি ছাড়’, ‘আমার ভাই অনশনে ভিসি কেন নিজ আসনে।’ এ ধরনের নানা স্লোগানে মুখোরিত হয়ে ওঠে কুয়েট প্রাঙ্গণ। প্রশাসনিক ভবনের সামনে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করে স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারে গিয়ে শেষ করেন। কফিন মিছিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দুইশতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেয়।
শিক্ষার্থীদের কফিনের মিছিল হওয়ার আগে গতকাল বুধবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় ৩৭ জন শিক্ষার্থীর সাময়িক বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের পাশাপাশি ৭টি আবাসিক হল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিন্ডিকেটের ১০২তম জরুরি সভায় ভাইস চ্যান্সেলরের নির্দেশক্রমে রেজিস্ট্রার মো. আনিছুর রহমান ভূঞা স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। আগামী ৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব একাডেমিক কার্যক্রম চালু করার কথা জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ১৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ১০১তম জরুরি সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক আগামী ৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব রকম একাডেমিক কার্যক্রম চালু এবং ২ মে আবাসিক হলগুলো খোলার বিষয়ে বলা হয়। তবে গতকাল অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ১০২তম (জরুরি) সভায় সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ২ মে’র পরিবর্তে আজ বিকালে খোলা হবে। এর আগে গত ১৩ এপ্রিল হল খুলে দেয়ার দাবিতে বিক্ষোভ এবং ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ২ মে হল খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। দুই রাত খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়ে ১৫ এপ্রিল ছয়টি ছাত্র হলের তালা ভেঙে হলে প্রবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। গত মঙ্গলবার রাতে ছাত্রীরাও হলের তালা ভেঙে প্রবেশ করেন। বর্তমানে কুয়েটের সব হলেই শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছেন। গত ১৪ এপ্রিল রাতে জরুরি সিন্ডিকেট সভায় বিগত ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৭ শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়। পাশাপাশি তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটির কাছে প্রেরণের নির্দেশ প্রদান করা হয়। এদিকে, শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরারের সঙ্গে আলোচনার পরও আমরণ অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করেনি আন্দোলনরত কুয়েট শিক্ষার্থীরা। বুধবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা কুয়েটে আসেন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এসময় শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের দাবি শোনেন এবং তাদের অনশন ভঙ্গ করে আইনের ওপর আস্থা রাখার অনুরোধ করেন। শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, তদন্ত কমিটি করা হয়েছে, কমিটি দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। সেই অনুযায়ী জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হবে। তিনি এসময় অসুস্থ শিক্ষার্থীদের দ্রুত চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন। তবে শিক্ষার্থীরা উপদেষ্টার আশ্বাসে আশ্বস্ত না হয়ে কুয়েট উপাচার্যকে অপসারণ না করা পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তিন সদস্যের কমিটি এসে গতকাল সকাল থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন। দুপুরে কুয়েটের প্রশাসনিক ভবনের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে কুয়েট শিক্ষক সমিতির নেতারা বলেন, চাপ দিয়ে উপাচার্যকে অপসারণ করা হলে তা মেনে নেয়া হবে না। অন্যথায় অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ রাখার হুঁশিয়ারি দেন তারা। এছাড়া শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললেও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা না বলায় হতাশা প্রকাশ করেন শিক্ষকরা। সবপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান শিক্ষকরা।
এ বিষয়ে অনশনরত শিক্ষার্থীদের কয়েকজন বলেন, ‘আমরা আমাদের এক দফা দাবিতে অনড়। ভিসি স্যার নামবেন, আমরা অনশন ভাঙব। আমাদের একটাই দাবি ভিসির অপসারণ। এর বাইরে আমরা আর অন্য কিছু ভাবছি না।’ শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার পরপরই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। সেখানে তারা উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন।
এদিকে কুয়েট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অনশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ১৭ নেতাকর্মী। এরমধ্যে এক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে পাঠানো হয়। গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সদস্যসচিব রেজওয়ান আহমেদ বলেন, ‘কুয়েটের উপাচার্যের পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরা অনশন চালিয়ে যাব।’ এ বিষয়ে সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আরেক যুগ্ম সদস্যসচিব সাকিব আহমেদ বলেন, ‘আমরা কুয়েটের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আমরণ অনশন শুরু করেছি। এরইমধ্যে আমাদের একজন অসুস্থ হয়ে গেছেন।’ এদিকে কুয়েটের চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে এবং অবিলম্বে কুয়েট উপাচার্য মাসুদের পদত্যাগ দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) আট শিক্ষার্থী। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিকী অনুষদ সংলগ্ন মহুয়া চত্বরে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ জাবি শাখার ব্যানারে এ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন তারা। অনশনরতরা হলেন- মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার সদস্য সচিব আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ও বাগছাস কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ হাসান ইমন ও জিয়া উদ্দিন আয়ান, চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস আঞ্জুম, নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুল হোসেন লিমন, লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মার্জিউর রহমান ও ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন। উপাচার্য মুহাম্মদ মাসুদের পদত্যাগ দাবি করে অনশনরত শিক্ষার্থীরা জানান, কুয়েটের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আমরা আমরণ অনশনে বসেছি। জুলাই আন্দোলন শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে দৃঢ় বন্ধন তৈরি করেছে আমাদের ঐক্যবদ্ধতা তা প্রমাণ করে। অনশনরত শিক্ষার্থী আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, ‘দুই দিন ধরে কুয়েটের শিক্ষার্থীরা উপাচার্য মাসুদের পদত্যাগের দাবিতে অনশন করছে। শিক্ষার্থীদের অনশনের পরিপ্রেক্ষিতে আজকে শিক্ষা উপদেষ্টা অনশনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন কিন্তু তিনি কোনো যৌক্তিক সমাধান করতে পারেননি। আমরা মনে করি কুয়েটের ভিসি মাসুদ তার পদে বহাল থাকার নৈতিকতা অধিকার হারিয়েছেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাকে অপসারণ করতে হবে।’
উদ্বিগ্ন শিক্ষা উপদেষ্টা: গতকাল বিকালে ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের সাহিত্য ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সিআর আবরার বলেছেন, সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতার বিষয়ে আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন।