ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় অন্তত ২৮ জন নিহত এবং ১৭ জন আহত হয়েছেন। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কাশ্মীরের পাহেলগাঁও এলাকায় আতঙ্ক ও উত্তেজনা বাড়ছে। গত মঙ্গলবার অনন্তনাগ বিভাগের পাহেলগাঁও এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠী পর্যটকদের ধর্মীয় পরিচয় জেনে জেনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটায় বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। ভারতে মুসলমানদের জন্য মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণে দান করা ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও বহু বছরের পুরোনো পরিচালনা পদ্ধতির বিল লোকসভায় পাস করা হয়েছে। যা ভারতীয় মুসলমানদের জন্য ক্ষতির কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ওয়াকফ বিল পাসকে কেন্দ্র করে হামলার ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
এদিকে কাশ্মীরের ইস্যুতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও ইরান সবাই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে ভারতের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়েছেন। একইসঙ্গে পাকিস্তান উদ্বেগ ও সমবেদনা জানিয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শাফকাত খান এক বিবৃতিতে বলেছেন, জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলায় এক হামলায় পর্যটকদের প্রাণহানির ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা নিহতদের নিকটাত্মীয়দের প্রতি সমবেদনা জানাই এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। ‘কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স’ নামে লস্কর-ই-তৈয়বার একটি উপধারা সোশ্যাল মিডিয়ায় এক বার্তায় হামলার দায় স্বীকার করে বলেছে, ‘জনতাত্ত্বিক পরিবর্তনের জন্য কাশ্মীরে ৮৫ হাজারেরও বেশি বহিরাগত বসতি গেড়েছে। এই প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে এই হামলা চালানো হয়েছে।’ তারা লিখেছেন, ‘যারা কাশ্মীরে অবৈধ বসতি স্থাপনের চেষ্টা করছে, তাদের ওপর আরও হামলা হবে।’
ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা রয়েছেন। মণীশ রঞ্জন নামের এই কর্মকর্তা বিহারের বাসিন্দা এবং হায়দরাবাদের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর কর্মকর্তা। নিহতদের মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিসার লেফটেন্যান্ট বিনয় নারওয়ালও রয়েছেন; তিনি হরিয়ানার কারনালের বাসিন্দা। সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, যেখানে হামলা হয়েছে, সেটি একটি বিস্তৃত তৃণভূমি। গত মঙ্গলবার সকালে সেখানে পর্যটকদের একটি দল গিয়েছিল। ওই সময় তাদের ওপর হামলা হয়। জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, বেসামরিকদের ওপর এখন পর্যন্ত আমরা যেসব হামলা দেখেছি, সেগুলোর তুলনায় এটি অনেক বড়। ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সৌদি সফর বাতিল করে দেশে ফিরেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জরুরিভিত্তিতে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে গেছেন। সেখানে একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন তিনি। পিটিআই জানিয়েছে, ঘটনাস্থল ছিল বৈসারান তৃণভূমি। সেখানে একটি রিসোর্টের কাছে হামলার পর অনেকের লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বার্তাসংস্থাটি আরও জানিয়েছে, ভারী অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত অস্ত্রধারীরা পাহাড়ের উপরের তৃণভূমির গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন। তারা ৪০ জনের একটি পর্যটক দলকে ঘিরে ফেলেন। এরপর এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করেন। পিটিআই সূত্রে বলা হয়েছে, এ ঘটনার পর মঙ্গলবার রাতে সৌদি বাদশার নৈশভোজ অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়েই নয়াদিল্লির বিমানে দেশে ফিরেছেন মোদি। যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের আমন্ত্রণে তৃতীয়বারের মতো সৌদি সফরে গিয়েছিলেন তিনি। গতকাল বুধবার রাতে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা ছিল তার। হিন্দুস্তান টাইমসের খবরে বলা হয়, বন্দুকধারীরা এসেছিলেন সেনার পোশাক পরে। সব মিলিয়ে ৪০ রাউন্ড গুলি চালিয়েছেন তারা। পুলওয়ামার পর এটিকে ভারতের বুকে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলা বলে অভিহিত করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো।
জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের মহাপরিদর্শক ভিডি কুমার বিরদী হিন্দিকে জানান, যেখানে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কোনো গাড়ি যেতে পারে না। যে পর্যটক দলের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়, সেই দলে ছিলেন গুজরাট থেকে আসা একজন। তিনি বলেছেন, হঠাৎ হামলা শুরু হলে মুহূর্তের মধ্যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়। সবাই দৌড়াতে শুরু করেন এবং কান্না-চিৎকার করতে থাকেন। ভারতের বিভিন্ন সংবামাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, ভারতীয় সেনারা ঘটনাস্থলের দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েপড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, মাটিতে অনেকের দেহ পড়ে আছে এবং লোকজন কান্না করছে ও সাহায্য চাইছে। পুলিশ জানিয়েছে, গুলিবিদ্ধ অনেক পর্যটককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুরো এলাকা সেনাসদস্যরা ঘিরে রেখেছেন এবং চৌকিগুলোতে গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে আরেকটি অভিযানের প্রস্তুতি চলছে।
কাশ্মীরে হামলার পর বন্দুকযুদ্ধে নিহত দুই: কাশ্মীরে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় পর্যটকরা নিহতের পর বারামুল্লায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তীব্র গুলি বিনিময়ে দুই সদস্য নিহত হয়। কাশ্মীরের পাহেলগামে ভয়াবহ হামলার একদিন পর নিরাপত্তা বাহিনীর চলমান অভিযানে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিনার কর্পস সামাজিকমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে এ তথ্য নিশ্চিত করে।
পাকিস্তানের আকাশপথ এড়িয়ে ভারতে ফিরেন নরেন্দ্র মোদি: কাশ্মীরে সন্দেহভাজন জঙ্গি হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে সৌদি আরব থেকে ফেরার সময় এয়ার ইন্ডিয়া ওয়ান বিমানটি পাকিস্তানের আকাশপথ এড়িয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, একটি ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইটের দৃশ্যে দেখা গেছে, মোদিকে বহনকারী ভারতীয় বিমান বাহিনীর বোয়িং ৭৭৭-৩০০ বিমানটি মঙ্গলবার সকালে রিয়াদের দিকে উড়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানের আকাশপথ ব্যবহার করেছে, কিন্তু রাতে ফেরার সময় তা না করে ঘুর পথে দিল্লি ফিরেছে। ঘুরপথে আসার এ দৃশ্যপট পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে ওই সময় পাকিস্তান থেকে সম্ভাব্য হুমকির বিষয়ে ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো সতর্ক ছিল।
বিমান ভাড়া বাড়ল দ্বিগুণ: কাশ্মীরের ঘটনার পর আটকেপড়া পর্যটকদের গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার পথ কঠিন হয়ে উঠেছে। বিমানের টিকিটের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। বিভিন্ন এয়ারলাইনের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, অধিকাংশ টিকিট হয় বিক্রি হয়ে গেছে অথবা টিকিটের দাম অনেক বেশি। কেউ যদি আজই টিকিট কাটতে চান, ‘সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে,’ বা ‘দুঃখিত, কোনো ফ্লাইট নেই।’ বার্তা সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, গত মঙ্গলবার সন্ত্রাসী হামলার খবর প্রকাশিত হওয়ার পরপরই শ্রীনগর থেকে দিল্লি, মুম্বাইসহ বড় শহরগুলোর বিমান ভাড়া লাফিয়ে বেড়েছে। সাধারণ সময়ে শ্রীনগর থেকে দিল্লি যাওয়ার জন্য ইন্ডিগোর ইকোনমি ক্লাসে টিকিটের দাম থাকে পাঁচ থেকে আট হাজার রুপি। এখন ১০ থেকে ১২ হাজার রুপি।
বিশ্ব নেতাদের নিন্দা: কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বার্তা দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এই বার্তা উল্লেখ করা হয়। বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণহানির ঘটনায় আমার গভীর সমবেদনা গ্রহণ করুন। আমরা এই জঘন্য ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। আমি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান আবারও নিশ্চিত করতে চাই।’ প্রধান উপদেষ্টার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য নেতারা নিন্দা জানান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘কাশ্মীর থেকে পাওয়া খবর অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ভারতের পাশে রয়েছি আমরা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, প্রধানমন্ত্রী মোদি ও রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে বার্তা দিয়ে জানান, ‘এই বর্বর হামলা ন্যায্যতার বাইরে। দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দেখতে চাই আমরা। ভারত-রাশিয়া মিলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই আরও জোরদার হবে।
সাজানো হামলা হতে পারে: কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনা ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ বা সাজানো হামলা হতে পারে বলে মন্তব্য করেছে পাকিস্তানির সংবাদমাধ্যম আরওয়াই নিউজ। গতকাল বুধবার এক প্রতিবেদনে এমন খবর দিয়েছে আরওয়াই নিউজ। এতে বলা হয়েছে, ‘বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এটি ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ বা সাজানো হামলা হতে পারে। অতীতেও মোদি সরকার এমন হামলা ঘটিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব হামলা প্রায়ই দেশটির অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা আড়াল করতে এবং পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব উস্কে দিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
প্রসঙ্গত, কাশ্মীরে ভারতের শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৯০-এর দশক থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতায় বহু সাধারণ মানুষ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রাণহানি হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার পর হিমালয়ের এ অঞ্চল বিভক্ত হয়। পারমাণবিক ক্ষমতাধর দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই পুরো কাশ্মীরকে নিজেদের বলে দাবি করে। এ নিয়ে দেশ দুটি বিগত কয়েক দশকে দুটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ ও একটি সীমিত সংঘাতে জড়িয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় সেনাসদস্য স্থায়ীভাবে কাশ্মীরে মোতায়েন রয়েছেন। ২০১৯ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাশ্মীরের আংশিক স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার করেন। কাশ্মীরে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সর্বশেষ বড় ধরনের হামলা হয় ২০২৪ সালের জুনে। সে সময় হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি বাসে বন্দুকধারীরা গুলি চালালে ৯ জন নিহত ও ৩৩ জন আহত হন। এর আগে ২০১৯ সালে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় অন্তত ৪৬ জন ভারতীয় সেনা নিহত হন। ভারত এই হামলার জেরে পাকিস্তানের ভেতরে বিমান হামলা চালায়।