ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে তীব্রতা এনেছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠনগুলো। গত মঙ্গলবার গাজাসিটির পূর্বে ইসরায়েলের ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটগুলোতে বড় ধরনের হামলার খবর দিয়েছে হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসসাম ব্রিগেডস এবং প্যালেস্টিনিয়ান ইসলামিক জিহাদের আল-কুদস ব্রিগেডস। আল-কুদস জানিয়েছে, তারা একঝাঁক ৬০ এমএম মর্টারশেল দিয়ে ইসরায়েলের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফোর্সকে আঘাত করেছেন। গাজাসিটির আল-তুফফাহ এলাকার পূর্বে অভিযান চালাচ্ছিল দখলদার বাহিনীটি। একই এলাকায় ইসরায়েলের ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটের ওপর আঘাত হানে আল-কাসসাম ব্রিগেডস। টানেলের ফাঁদ তৈরি করে সেখানে সেনাদের যেতে প্রলুব্ধ করেন তারা। টানেলের প্রবেশপথে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই ইউনিটের সেনাদের ওপর এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে বেশ কয়েকজন সেনা হতাহত হন বলে নিশ্চিত করেছে আল-কাসসাম। ইসরায়েলি সংবাদপত্র মারিভ জানিয়েছে, হামাসের বাস্তবিক অবস্থান এবং যুদ্ধ অব্যাহত রাখার সক্ষমতাকে আমলে নিয়ে তাদের নির্মূল করার পরিকল্পনা থেকে দৃশ্যত সরে এসেছে ইসরায়েল। শুরুতে হামাসকে নিয়ে যে ধারণা ছিল ইসরায়েলি প্রশাসনের, এখন সেই ধারণা থেকে সরে এসেছেন তারা। হামাসের যোদ্ধার সংখ্যা প্রায় অক্ষুণ্ণ থাকা, পাশাপাশি নতুন যোদ্ধা নিয়োগ এবং ব্রিগেড থেকে তাদের ব্যাটালিয়নে সংগঠিত হওয়ার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তারা এই ধারণায় স্থির হয়েছেন যে, হামাসের গেরিলা কৌশলকে পরাজিত করা ইসরায়েলি বাহিনীর জন্য বেশ কঠিন একটি বিষয়। সামরিক কর্মকর্তাদের বরাতে মারিভ বলেছে, এই অবস্থায় হামাসকে নির্মূল করার লক্ষ্য কোনোভাবেই বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আরেক ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজ জানিয়েছে, তাদের সাদার্ন কমান্ড স্বীকার করছে যে, রাফা শহরে পুনরায় সংগঠিত হয়ে বিপুল সংখ্যক হামাস যোদ্ধাদের উপস্থিতি ইসরায়েলি লক্ষ্যকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
২২তম মার্কিন এমকিউ-নাইন ড্রোন ভূপাতিত, দুই রণতরীতে হামলা: ইয়েমেনের হুথি আনসার-আল্লাহর নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী গত মঙ্গলবার আরও একটি মার্কিন এমকিউ-নাইন রিপার ড্রোন ভূপাতিত করেছে। বাহিনীর তরফে জানানো হয়, ইয়েমেনি আকাশসীমায় শত্রুতামূলক মিশন পরিচালনার সময় ড্রোনটিকে ভূপাতিত করা হয়। ইয়েমেনি সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি সারফেস টু এয়ার মিসাইল দিয়ে ড্রোনটিকে আঘাত করা হয়। এর মাধ্যমে কেবল এপ্রিল মাসেই সাতটি এবং ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ২২টি এমকিউ-নাইন ড্রোন ভূপাতিত করেছেন তারা। একই বিবৃতিতে সারি জানান, লোহিত সাগর এবং আরব সাগরে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস হ্যারি ট্রুম্যান এবং ইউএসএস কার্ল ভিনসনে আবার হামলা চালিয়েছেন তারা। রণতরী দুটির সঙ্গে থাকা যুদ্ধজাহাজগুলোও হামলার শিকার হয়। ক্রুজ মিসাইল এবং ড্রোন ব্যবহার করে এসব হামলা চালানো হয়েছে বলে জানান তিনি। সারি জানান, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইয়েমেনের প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এসেছে। এর মাধ্যমে তারা শত্রুর গতিবিধি সফলভাবে শনাক্ত করেছেন এবং অনেক হামলাকে নিখুঁতভাবে পরাস্ত করেছেন। ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি ইয়েমেনের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, গাজায় আগ্রাসন বন্ধ এবং উপত্যকাটি থেকে অবরোধ তুলে না নেওয়া পর্যন্ত ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আদালতে ভয়াবহ তথ্য: ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেতের প্রধান রোনেন বার প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছেন। সুপ্রিমকোর্টের দেওয়া বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, নেতানিয়াহু তাকে বরখাস্ত করার চেষ্টা করেছেন, কারণ তিনি নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার অবৈধ আদেশ মানতে রাজি হননি। অন্যদিকে, নেতানিয়াহু পাল্টা অভিযোগ এনে বলেছেন, ‘রোনেন বার বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, আর এই বিশ্বাসভঙ্গের কারণেই ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলে হামলা চালাতে সক্ষম হয় হামাস। রোনেন বার সুপ্রিমকোর্টে জানান, বরখাস্তের বিষয়টি নেতানিয়াহুর মাথায় আসে ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে। ওই সময় নেতানিয়াহু বারবার শিন বেতকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং প্রতিবাদে অর্থায়নকারীদের ওপর নজরদারি চালানো হয়। আরও বিস্ফোরক অভিযোগে তিনি বলেন, একটি নিরাপত্তা সংক্রান্ত অনুরোধপত্রে তাকে স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছিল, যা নেতানিয়াহুকে দুর্নীতির মামলায় বিচার এড়াতে সাহায্য করতে পারত। ওই মামলায় প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ঘুষ, প্রতারণা ও জনগণের বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে। রোনেন বার বলেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার আগে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছিল, কিন্তু সেই সতর্কতা উপেক্ষা করা হয়। শিন বেত সেই হামলার পেছনের ব্যর্থতা এবং হুঁশিয়ারি উপেক্ষার বিষয়েও তদন্ত চালিয়ে আসছে। এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে রোনেন বারের সব বক্তব্যকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে দাবি করা হয়েছে। তাদের বক্তব্য, বরখাস্তের পেছনে কোনো তদন্ত বন্ধ করার উদ্দেশ্য ছিল না।
গাজায় বর্বর হামলায় নিহত আরও ৩২: আলজাজিরা জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় নির্বিচার বোমাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে এবং গাজাসিটির একটি আশ্রয়কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে। গতকাল বুধবারের এই হামলায় আশ্রয়কেন্দ্রে আগুন লেগে এক শিশুসহ অন্তত ১০ জন নিহত হন।
তাছাড়া, গত মঙ্গলবার উপত্যকাজুড়ে কমপক্ষে ৩২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের গণহত্যামূলক আগ্রাসনে ভূখণ্ডটিতে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫১ হাজার ২৬৬ জনে পৌঁছেছে বলে জানায় মন্ত্রণালয়। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় আহত ৬০ জনেরও বেশি মানুষকে মঙ্গলবার গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে সংঘাতের শুরু থেকে আহতের সংখ্যা বেড়ে ১ লাখ ১৬ হাজার ৯৯১ জনে পৌঁছেছে। অনেক মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় পড়ে থাকলেও উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না।