ঢাকা ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বছরজুড়ে অস্থির নিত্যপণ্য বাজার

বছরজুড়ে অস্থির নিত্যপণ্য বাজার

করোনার কারণে বছরজুড়েই খুব একটা ভালো ছিল না দেশের অর্থনীতি। এর মাঝে কয়েক দফা বন্যায় নিত্যপণ্যের বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়। তবে তারও আগে বছর শুরু হয় পেঁয়াজের আগুনে দাম নিয়ে। জানুয়ারিতে প্রায় ১৫০ টাকায় কিনতে হয়েছে পেঁয়াজ। একই সময় বাড়তি ছিল চাল ও তেলের দামও। পরে বছরজুড়েই চাল, তেল, সবজি, পেঁয়াজ, আলুসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দাম ভুগিয়েছে ক্রেতাদের। আর শেষ মুহূর্তে চলতি ডিসেম্বরে ভরা মৌসুমেও চালের মূল্যবৃদ্ধি ও তেলের দামের নতুন রেকর্ডে বছর শেষে এসেও মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল বিভিন্ন নিত্যপণ্য। বেশ কিছু পণ্যের সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড হয়েছে এ বছর। করোনায় মানুষের আয় কমে গেলেও প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। বেড়েছে নিত্যদিনের খরচ। এর মধ্যে চালের দামই বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। করোনার প্রভাবে এমনিতেই সব দিকে অস্থিরতা, এমন অবস্থায় নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে ভোক্তারা দিশাহারা হয়ে পড়েন। সবচেয়ে বেশি ভুগছেন গরিব ও নিম্নবিত্তরা। সীমিত আয়ে আকাশছোঁয়া দামে নিত্যপণ্য কিনতেই দিশাহারা অবস্থা।

জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এ বছর এমনিতেই করোনার কারণে মানুষের আয় কমে গিয়েছিল। দরিদ্রসীমার নিচে যায় প্রচুর মানুষ। এ অবস্থায় নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম তাদের বেশ ভোগান্তিতে

রেখেছে। কারণ মানুষের যখন আয় বাড়ে, তখন পণ্যের দাম বাড়লে তা খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারে না; কিন্তু এবার তার উল্টোটা হয়েছে। একদিকে আয় কমেছে, অপরদিকে দাম বেড়েছে। এতে মানুষের খরচের ওপর দ্বিগুণ চাপ তৈরি করেছে। বিশেষ করে চাল ও তেলের দাম কম আয়ের মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়েছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যাতে মূল্যস্ফীতি বেশি না হয়। কোনো পণ্যের দাম অযাচিতভাবে না বাড়ে।

পেঁয়াজ : নতুন বছরের শুরু থেকেই অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল পেঁয়াজের বাজারে। আগের বছরের (২০১৯) শেষ কয়েক মাসে এ নিত্যপণ্যটির রেকর্ড দাম ক্রেতাদের নাভিশ্বাসের ধারা অব্যাহত থাকে নতুন বছরেও। বছরের প্রথম সপ্তাহেই খুচরায় প্রতি কেজি দেশি নতুন পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়। মিয়ানমার ও পাকিস্তানের পেঁয়াজ ছিল ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। এরপরই ধীরে ধীরে কমেছে এ নিত্যপণ্যের দাম। পরে বছরের শেষে সেপ্টেম্বরে অস্থিরতা শুরু হয় পেঁয়াজের বাজারে, আবারও সেঞ্চুরি ছাড়ায় দাম। তবে সে অবস্থা কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বছরের শেষে এসে বর্তমানে দেশি পেঁয়াজের দাম রয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। এরই মধ্যে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির পথ উন্মুক্ত করেছে। এতে আরও দাম কমতে পারে।

তেল : ভোজ্য তেলের দামও বেড়েছে এ বছর। বছর শুরুর মাসে প্রায় ৯০ টাকার কছাকাছি ছিল সয়াবিন তেলের দাম। পাম ওয়েল ছিল ৭৫ টাকায়। মাঝে কয়েক দফায় দামের কম-বেশি হয়েছে। কিন্তু শেষ ২ মাসে এসে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে দাম। এ অবস্থায় অক্টোবরের শেষের দিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে বৈঠকে ব্যবসায়ীরা তেলের দাম কমানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু খুচরা বাজারে তার প্রতিফলন তো নেই-ই, উল্টো দাম আরও বেড়েছে। নভেম্বরেই প্রথমবারের মতো খোলাবাজারে খুচরা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকার উপরে। প্রতি লিটার বিক্রি হয় ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়। মাসখানেক ওই দামে স্থির থাকালেও আবারও বাড়তে শুরু করে দাম। বর্তমানে লিটারপ্রতি খুচরায় ১১৮ থেকে ১২০ টাকা দরে পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে। আর বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবেই বছর শেষের দাম ধরে খুচরা বাজারে গত ১ বছরের ব্যবধানে খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে ২৮ শতাংশ। পাম অয়েল ও পাম অয়েল সুপারে বেড়েছে ২৭ ও ২৮ শতাংশ। বোতলজাত সয়াবিনে দাম বেড়েছে ১৬ শতাংশ। তেলের এ দাম দেশের বাজারে সর্বোচ্চ, দামের রেকর্ডে। ৩ মাসে লিটারে দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা।

চাল : বছরের শুরুতেও কিছুটা বাড়তি ছিল চালের দাম। খুচরায় প্রতি কেজি পুরোনো মিনিকেট ও নাজিরশাল চাল বিক্রি হয়েছিল ৫০ থেকে ৫২ টাকায়। একই সময় মোটা চালের দাম ছিল ৩২ থেকে ৩৫ টাকায়। তবে এরপর ধানের প্রধান মৌসুম বোরো শেষ হয়েছে। রেকর্ড ফলনও হয়েছে। এখন চলছে আমনের শেষ সময়। বন্যার কারণে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও গত মৌসুমের চেয়ে অন্তত ১০ থেকে ১২ লাখ টন বেশি উৎপাদনও হবে। এরই মধ্যে নতুন আমন চাল বাজারেও আসতে শুরু করেছে। তারপরও বাজারে সব ধরনের চালের দাম বাড়তি। গত ২ থেকে ৩ মাসেই প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। বস্তায় (৫০ কেজি) দাম বেড়েছে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা।

দাম বাড়ার শুরুতেই সেপ্টেম্বরে শেষ সপ্তাহে চালের দাম বেঁধে দেয় সরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চালকল মালিকদের বৈঠকে প্রতি কেজি সরু মিনিকেট চাল ৫১ টাকা ৫০ পয়সা ও প্রতি ৫০ কেজির বস্তা ২ হাজার ৫৭৫ টাকায় বিক্রি করতে হবে। মাঝারি মানের চাল প্রতি কেজি ৪৫ টাকা ও বস্তা ২ হাজার ২৫০ টাকায় বিক্রি ঠিক করে দেয়। তবে বাজারে এর খুব একটা কার্যকারিতা চোখে পড়েনি। বর্তমানে খুচরায় প্রতি কেজি মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা দরে। এছাড়া মাঝারি মানের চাল বিক্রি হয়েছে ৫৭ থেকে ৫৮ টাকা এবং মোটা চালের কেজি বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা দরে। আর একেবারে নিম্নমানের মোটা চালের কেজিও ৪৮ টাকা। সরকারি সংস্থা টিসিবিও বলছে বছরের ব্যবধানে এখন সরু চালে ২০ শতাংশ, মাঝারি চালে ২৫ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চালের আমদানি শুল্ক কমানোর পদক্ষেপও নেয় সরকার।

এদিকে আমনের ভরা মৌসুমে আড়তদার-মিলাররা ‘কারসাজি করে’ চালের দাম বাড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক। গত রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, সরকারি গুদামে চাল কমে গেছে। গত বছর প্রায় ১৩ লাখ টনের মতো খাদ্য ছিল, এ বছর সেটা কমে ৭ লাখ টনে নেমে এসেছে। ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকার ৫ থেকে ৬ লাখ টন চাল বিদেশ থেকে আমদানি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশের মিলাররা, আড়তদাররা, জোতদাররা, যারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা চালের দাম বাড়ান এবং এবারও তারা সেই কাজ করছেন। মৌসুমের সময় তারা এখনও ধান কিনছেন এবং ধান ও চালের দাম দুটোই বাড়িয়ে দিয়েছেন। চাল আমদানিতে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশের মতো শুল্ক দিতে হতো। এ পরিস্থিতিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা যাবে।

সবজি : অন্য নিত্যপণ্যের মতো এবার বছরজুড়েই ভুগিয়েছে সবজির আগুনে দাম। প্রায় ৬ মাস ধরেই ১০০ টাকার আশপাশে বিক্রি হয়েছে বেশকিছু সবজি। আগের মতোই বেশকিছু সবজি ১০০ টাকার উপরেই রয়েছে। এর মধ্যে পাকা টমেটো ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, শসা ১০০ থেকে ১০০, উচ্ছে ১০০, বরবটির কেজি ১১০ থেকে ১১০, শিম কেজি ১৪০ থেকে ১৬০, বেগুন ৭০ থেকে ১০০, পটোল ৭০ থেকে ৮০, ঝিঙা, কাঁকরোল ও ধুন্দল ৬০ থেকে ৭০, ফুলকপি ও বাঁধাকপির পিস বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা। ডাবল সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে প্রতি কেজি কাঁচামরিচ ২২০ থেকে ২৫০ টাকাও বিক্রি হয়েছিল। তবে বর্তমানে শীতের মৌসুমি সবজি বাজারে আসায় প্রতি কেজির দাম ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যেই রয়েছে।

আলু : এ বছর আগুনে দামের ক্ষেত্রে বাদ ছিল না আলুও। বাজারে কেজিপ্রতি আলুর দাম ৫০ টাকা ছাড়িয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এতে দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বাজার করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রতি কেজি আলু খুচরা পর্যায়ের এ দাম অযৌক্তিক বলে মনে করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। তাই ভোক্তা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা কেজি দর বেঁধে দিয়ে আলু বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করতে ৬৪ জেলার প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠিও দিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে খুচরা পর্যায়ে কেজিপ্রতি ৩০, পাইকারিতে ২৫ ও হিমাগার থেকে বিক্রির ক্ষেত্রে ২৩ টাকায় বিক্রির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ দামে আলু বিক্রি না করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়; তবে বাজারে প্রভাব নেই বললেই চলে। খুচরায় এখনও ৫০ টাকাতেই রয়েছে প্রতি কেজি আলু।

বছরের কিছুটা সময় ভুগিয়েছে ডিমের দাম। করোনার কারণে ঘোষিত সাধারণ ছুটি ও এর পরবর্তী ৩ থেকে ৪ মাস প্রতি হালি লাল লেয়ার মুরগির ডিম সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৪২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এ সময় দেশি মুরগি ও হাসের ডিম ৫৫ থেকে ৫৮ টাকায় হালিও বিক্রি হয়। তবে বর্তমানে লাল ডিম ৩০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া নাগালেই ছিল ব্রয়লার ও অন্যান্য মুরগির দাম। বছরজুড়েই প্রতি কেজি ব্রয়লার ১১৫ থেকে ১৩০ টাকায়, লেয়ার ২২০ থেকে ২৩০ টাকায়, পাকিস্তানি মুরগি ২২০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে দাম বেশি হলেও গরুর মাংস ৫৫০ থেকে ৫৮০ টাকায়, খাসির মাংস ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় স্থিতিশীল ছিল। খুব একটা ওঠানামা ছিল না মুদি পণ্যে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত