চুল পড়া বা টাকের সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে চমকপ্রদ ও আধুনিক পদ্ধতিটি হলো হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট বা চুল প্রতিস্থাপন।
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট কি?
দেহের অন্যান্য অঙ্গ (যেমন : কিডনি, চোখ) এর মতো বর্তমানে চুলও প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে অন্য কোনো মানুষের চুল রোগীর মাথায় বসিয়ে দেয়া হয় না। এখানে মাথার এক অংশ থেকে চুল নিয়ে অন্য অংশে লাগিয়ে দেয়া হয়। আমাদের মাথার চুলগুলোকে সাধারণত ২ ভাগে ভাগ করা যায়।
১. টেম্পোরারি জোন বা অস্থায়ী অংশ।
২. পারমানেন্ট জোন বা স্থায়ী অংশ মাথার সামনের অংশকে বলা হয় টেম্পোরারি জোন। এ অংশের চুলগুলো স্থায়ী নয়। অর্থাৎ বয়সের সঙ্গে বা কোনো শারীরিক জটিলতায় এ চুলগুলো ঝরে যায়। মাথার পেছন সাইড ও কানের দুপাশের অংশকে বলে পারমানেন্ট জোন। এই অংশের চুল স্থায়ী। এরা জেনেটিক বা হরমোনাল কারণে সময়ের সঙ্গে ঝরে পড়ে না। এজন্যই বংশগত বা হরমোনজনিত কারণে টাকের সমস্যা হলে মাথার সামনের দিকের চুলগুলোই ঝরে পড়তে দেখা যায়। মেয়েদের ক্ষেত্রেও চুল কমে যেতে থাকে। সামনের দিক থেকে পারমানেন্ট জোনের যেখান থেকে চুল বা ফলিকল তুলে আনা হয় তাকে বলা হয় ‘ডোনার এরিয়া’।
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট কীভাবে করা হয়?
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট একটি সূক্ষ্ম সার্জারি। এক বা দুজন নয়, সার্জারিটিতে প্রয়োজন হয় প্রশিক্ষিত হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জনদের একটি দলের।
অপারেশনের আগে সবসময়ই রোগীর ওপর লোকাল এ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করা হয়। হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের ক্ষেত্রে এ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করা হয় মাথার ংপধষঢ়-এ।
তিনটি পদ্ধতি রয়েছে।
১. এফইউটি (Follicular Unit Transplantation)
২. এফইউই (Follicular Unit Extraction)
৩. ডিএইচআই (Direct Hair Implantation)
এফইউটি পদ্ধতিতে মাথার পেছন থেকে ঝঈঅখচ চওড়ায় প্রায় আধ ইঞ্চি পরিমাণ কেটে চামড়াসহ তুলে আনা হয়। সেখান থেকে ফলিকল কেটে বের করে আনা হয় কৃত্রিমভাবে। সে ফলিকল ইনজেকশন পুশ করে করে লাগানো হয় মাথার সামনের অংশে। এ পদ্ধতিতে ৪ ঘণ্টায় প্রায় ২০০০ চুল লাগানো যায়।
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টে এফইউটি পদ্ধতিটি ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। কারণ, এ পদ্ধতিটিতে তুলনামূলক জটিলতা বেশি। মাথার পেছনে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয় সেটি সেলাই করা হয় এবং তা শুকাতে প্রায় ১০ দিন লেগে যায়।
এফইউই (ঋটঊ) পদ্ধতিতে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের জন্য ব্যবহার করা হয় একটি মাইক্রোমটর। এই মাইক্রোমটর দিয়ে ‘ডোনার এরিয়া’ থেকে প্রতিটি চুলকে আলাদা আলাদা করে তুলে আনা হয়। এতে একটি পাঞ্চ থাকে যা দিয়ে একটি একটি করে চুল তুলে আবার লাগিয়ে দেয়া হয়।
এ পদ্ধতিতে এফইউটি এর মতো কাটাছেঁড়ার কোন প্রয়োজন পড়ে না। তবে মোটরের কারণে ট্রান্সসেকশন বা গোড়া কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ‘ডিএইচআই’ই হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতি। চুল প্রতিস্থাপনে এ পদ্ধতিতে হ্যান্ড পাঞ্চ ব্যবহার করে প্রতিটি চুল হাত দিয়ে তোলা হয়। যদিও হাত দিয়ে করা হয় বলে সময় বেশি লাগে। তবে কোন কাটাছেঁড়া বা মাইক্রোমটরের ব্যবহার নেই বলে এতে জটিলতা কম।
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট কাদের জন্য?
অনেকে আছেন যারা ২৫-৩০-এ পা রাখতে না রাখতেই বংশগত বা হরমোনজনিত কারণে টাকের সমস্যায় পড়ে যান। মেয়েদের ক্ষেত্রে মনোপজের পর চুল পড়ার হার স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেড়ে যায়। আবার দুর্ঘটনাজনিত কারণেও অনেকে হারিয়ে ফেলেন নিজের প্রিয় চুলগুলো। এরকম কিছু ক্ষেত্রে যেখানে নতুন করে চুল গজানো প্রায় অসম্ভব, সেখানেই হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট তার সাফল্য দেখাতে প্রস্তুত!
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট বা চুল প্রতিস্থাপন করতে পারেন যে কেউই। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগের রোগীদের ক্ষেত্রে রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকলে সার্জারিতে কোন জটিলতা দেখা দেয় না।
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের খরচ : অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গ্রাফটপিছু টাকা হিসেব করা হয়। এখানে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টে প্রতি গ্রাফট ২৫ থেকে ৩০ টাকায় করা সম্ভব। তবে সার্জনদের পরিশ্রম ও ক্লিনিকভেদে ফির তারতম্য হয়ে থাকে।
কতদিনে ফল পাওয়া যাবে : প্রতিস্থাপিত চুল কিছুদিন পর ঝরে গিয়ে সেখানে পুনরায় চুল গজাতে শুরু করে। ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যে চুল গজানো শুরু হয়। সে হিসেবে আপনি এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের সুবিধাগুলো পেতে শুরু করবেন।
একটা বিষয় মনে রাখা খুবই জরুরী। ট্রান্সপ্লান্টের পরবর্তী সাধারণত ১ বছরের জন্য ফিনেসটেরাইড জাতীয় খাবার ওষুধ ও মিনক্সিডিল জাতীয় লাগানোর ওষুধ দেয়া হয়! সঙ্গে পিআরপি থেরাপি অনেক বেশি ভালো ফল দেয়!
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের সুবিধা : হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টের সুবিধা মূলত ন্যাচারাল সৌন্দর্য। চলাফেরা, খেলাধুলা বা দৌড়ঝাঁপ কোনোকিছুতেই বিন্দুমাত্র সমস্যা হয় না।
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টই টাক সমস্যার একমাত্র নিরাপদ ও স্থায়ী সমাধান। এছাড়া মহিলাদের চুলের ঘনত্ব বাড়িয়ে সৌন্দর্য বাড়াতেও এটি শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারে।
এই চুলে কোনো কৃত্রিমতা নেই। এটি স্থায়ী। চুলের ঘনত্বও ভালো হয়। সে চুল আপনি কেটে ছোট করতে পারেন, নিয়মিত শ্যাম্পু-কন্ডিশনিং, অয়েল ম্যাসাজও করতে পারেন। রিবন্ডিং বা কার্ল করতেও কোনো সমস্যা হবে না। এমনকি ন্যাড়া করলেও তাতে নতুন করে চুল গজাবে!
শুধু মাথা নয়, হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করা যাচ্ছে, ভ্রূ, গোঁফ দাঁড়িতেও। কারণ, অনেক সময় কোন দুর্ঘটনায় ভ্রু বা গোঁফের ক্ষতি হয়ে যায়। তাছাড়া অনেকের গোঁফ ও থুতনির দাঁড়ির মধ্যে চুল থাকে না কিন্তু তারা ফ্রেঞ্চকাট রাখতে চান! তাদের এ সমস্যার সমাধানেও প্রয়োজন হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট। আজকাল জুলফিতেও হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করা যাচ্ছে। ফলিকল লাগালে চুল আসবেই। ভয়ের আশঙ্কা নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে আপনি শতভাগ নিশ্চিত থাকতে পারেন।