গাইনোকোমাস্টিয়া-পুরুষের লজ্জার কারণ

প্রকাশ : ১১ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  প্রফেসর ডা. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ

গাইনোকোমাস্টিয়া একটি গ্রীক পরিভাষা। এখানে গাইনি অর্থ হলো মেয়েদের মতো, আর মাস্টিয়া অর্থ হলো স্তন। অর্থাৎ, মেয়েদের মত স্তন। এখানে অতিরিক্ত glandular tissue এবং fat-এর সমন্বয়ে বড় স্তন এর রূপ ধারন করে। গাইনোকোমাস্টিয়া প্রকৃত পক্ষে পুরুষদের স্তন গ্রন্থি টিস্যু বৃদ্ধির সঙ্গে স্তন বৃদ্ধির একটি অবস্থা। গাইনোকোমাস্টিয়া সব বয়সের পুরুষদের মধ্যে দেখা যায়, তবে নবজাতক, বয়ঃসন্ধিকালে এবং বৃদ্ধ বয়সে বেশি দেখা যায়। টেস্টোস্টেরন (পুরুষ যৌন হরমোন) এবং ইস্ট্রোজেন (মহিলা যৌন হরমোন) হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে গাইনোকোমাস্টিয়া হয়।

গাইনোকোমাস্টিয়া একপাশে বা দুইপাশেই হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুইপাশে হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে একপাশে হতে পারে। অথবা উভয় পাশে সাইজের ভিন্নতা হতে পারে।

গাইনোকোমাস্টিয়ার কারণ ভেদে প্রকারভেদ

১।সিডো-গাইনোকোমাস্টিয়া

(Psudogynecomastia)

শৈশবে এই সিডো-গাইনেকোমাস্টিয়ার সূত্রপাত ঘটে, স্তনে অতিরিক্ত চর্বি ডিপোজিশনের কারণে। এ ধরনের গাইনোকোমাস্টিয়ার চিকিৎসায় সাধারণত খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক ব্যায়ামকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। সার্জারির প্রয়োজন হয় না।

২। জুভেনাইল গাইনোকোমাস্টিয়া (Juvenile Gynecomastia)

বয়সন্ধিকালের ট্রান্সিশনাল সময়ে জুভেনাইল গাইনোকোমাস্টিয়ার উদ্ভব ঘটে। এ ধরনের গাইনেকোমাস্টিয়ার চিকিৎসা সার্জারির মাধ্যমেই করতে হয়। অনেক সময় ছোট হলে সাধারণত সুস্থ হয়ে যায়।

৩। ড্রাগ ইন্ডিউসড গাইনেকোমাস্টিয়া (Drug or Chemical Induced Gynecomastia)

বিভিন্ন রকম ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াতে যেমন- (Thiazide, H2 Blocker, Digoxin, High Soybean Content Food) বা খাদ্য শস্য, দুধ বা মাছ-মাংশে পরোক্ষভাবে প্রয়োগকৃত হরমোনের প্রভাবে এই ধরনের গাইনোকোমাস্টিয়া হয়ে থেকে, যার একমাত্র চিকিৎসা সার্জারি। যে ওষুধের কারণে এটি হয়েছে সে ওষুধ বন্ধ করে দিলে আর বৃদ্ধি পায় না। তবে যতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে সেটি সার্জারির মাধ্যমেই চিকিৎসা করতে হয়।

গবেষণা বলছে আরো কিছু ওষুধের ব্যাবহার ড্রাগ ইন্ডিউসড গাইনোকোমাস্টিয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত-

অ্যান্টি-অ্যান্ড্রোজেন ওষুধ : এই ওষুধগুলো বর্ধিত প্রোস্টেট, প্রোস্টেট ক্যান্সার এবং অন্যান্য ব্যাধিগুলোর চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ হলো স্পিরোনোল্যাক্টোন, ফিনাস্টেরাইড, এবং ফ্লুটামিড।

অ্যানাবলিক স্টেরয়েড এবং অ্যান্ড্রোজেন : এই ওষুধগুলো বিলম্বিত বয়ঃসন্ধি, পেশি ক্ষয় এবং অন্য রোগের কারণে হরমোনের ঘাটতির চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়।

এইডসের জন্য ওষুধ : এইচআইভি রোগীদের জন্য কিছু ওষুধ, যেমন এফাভিরেঞ্জ, ইস্ট্রোজেনের মতো বৈশিষ্ট্যযুক্ত এবং গাইনোকোমাস্টিয়া হতে পারে।

অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধ : ডায়াজেপামের মতো ওষুধগুলো গাইনোকোমাস্টিয়া হতে পারে।

অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (ADHD) ওষুধ : অ্যাডেরালের মতো ওষুধ যাতে অ্যামফেটামাইন থাকে সেগুলি গাইনোকোমাস্টিয়া হতে পারে।

অ্যান্টিবায়োটিক : সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ওষুধগুলো গাইনোকোমাস্টিয়া হতে পারে। ট্রাইসাইক্লিক এন্টিডিপ্রেসেন্টস স্তনকে বড় করে তুলতে পারে।

কেমোথেরাপির ওষুধ : ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ গাইনোকোমাস্টিয়া হতে পারে।

আলসারের ওষুধ : সিমেটিডিনের মতো ওষুধ স্তন বড় করতে পারে।

পেট খালি করার ওষুধ : মেটোক্লোপ্রামাইডের মতো ওষুধ স্তন বড় করতে পারে।

হার্টের ওষুধ : ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার এবং ডিগক্সিনের মতো ওষুধগুলি গাইনোকোমাস্টিয়ার জন্য দায়ী হতে পারে।

৪। সিস্টেমিক ডিজিজ গাইনেকোমাস্টিয়া (Systemic Disease Gynecomastia)

শারীরিক নানা জটিল অসুখ এর প্রভাবেও গাইনোকোমাস্টিয়া হয়ে থাকে, যাকে বলা হয় ‘সিস্টেমিক ডিজিজ গাইনেকোমাস্টিয়া’। এ ধরনের রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- CushingÕs Syndrome Ges Cirrhosis Liver।

স্তনের সাইজ ও ধরন অনুযায়ী ৪টি গ্রেডে গাইনেকোমাস্টিয়াকে ভাগ করা হয়।

গ্রেড ১ - অতিরিক্ত ত্বক ছাড়া স্তনের সামান্য বৃদ্ধি

গ্রেড ২ - অতিরিক্ত ত্বক ছাড়া মাঝারি মাপের বৃদ্ধি

গ্রেড ৩ - অতিরিক্ত ত্বক সমেত মাঝারি বৃদ্ধি

গ্রেড ৪ - অতিরিক্ত ত্বক সমেত ভালো বৃদ্ধি

গাইনেকোমাস্টিয়া এর ঝুঁকির কারণগুলো কি কি?

কিছু কারণ গাইনোকোমাস্টিয়া হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। এই কারণগুলো হলো : বার্ধক্য, কৈশোর, অ্যাথলেটিক পারফরম্যান্সের উন্নতির জন্য অ্যানাবলিক স্টেরয়েড ব্যবহার করা, লিভারের ব্যাধি, কিডনি ব্যর্থতা, থাইরয়েড রোগ, টিউমার, ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোমের মতো স্বাস্থ্যের অবস্থা, অ্যান্টি-এন্ড্রোজেন, অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস, অ্যান্টি-আলসার ওষুধ, এডিএইচডির ওষুধ, এইডসের ওষুধ ইত্যাদি ব্যবহার। অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন, অবৈধ ওষুধের ব্যবহার, ল্যাভেন্ডার তেলের মতো ভেষজ পণ্যের ব্যবহার, অবৈধ ওষুধ, অ্যালকোহল এবং বিনোদনমূলক ওষুধের ব্যবহারও গাইনেকোমাস্টিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।

যেমন : মারিজুয়ানা, মদ, অ্যামফিটামাইনস, হেরোইন, অ্যানাবলিক স্টেরয়েড (পেশি নির্মাণ এবং অ্যাথলেটিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত), মেথাডোন।

গাইনেকোমাস্টিয়া এর লক্ষণ কি কি?

গাইনোকোমাস্টিয়ায় আক্রান্ত অনেক পুরুষের কোনো উপসর্গ নাও থাকতে পারে। যাইহোক, তাদের মধ্যে কিছু নিম্নলিখিত উপসর্গ আছে : ব্যথা, স্তনের টিস্যু ফোলা, স্তনের কোমলতা, স্তনের সংবেদনশীলতা, স্তনবৃত্ত স্রাব।

কীভাবে গাইনেকোমাস্টিয়া নির্ণয় করবেন?

শারীরিক পরীক্ষা : ডাক্তার প্রথমে রোগীকে শারীরিকভাবে পরীক্ষা করবেন। রোগীর সম্পূর্ণ চিকিৎসা ইতিহাস এবং পারিবারিক ইতিহাস সহ রোগীর লক্ষণগুলো উল্লেখ করা হয়।

রক্ত পরীক্ষা : রক্তে হরমোনের মাত্রা এবং অন্তর্নিহিত সংক্রমণের উপস্থিতি পরীক্ষা করার জন্য একটি রক্ত পরীক্ষা কার্যকর।

স্তন আল্ট্রাসাউন্ড : শব্দ তরঙ্গ স্তন বৃদ্ধির স্পষ্ট ছবি পেতে ব্যবহার করা হয়।

ম্যামোগ্রাম : এটি স্তনের টিস্যুর কোনো পরিবর্তন বা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পরীক্ষা করতে সাহায্য করে।

কম্পিউটারাইজড টোমোগ্রাফি (সিটি) স্ক্যান এবং ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই) স্ক্যান : এগুলো শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ যেমন স্তন টিস্যুর স্পষ্ট ছবি পেতে ইমেজিং পরীক্ষা করা হয়।

টেস্টিকুলার আল্ট্রাসাউন্ড : টেস্টিসের আশপাশের এলাকার স্পষ্ট ছবি তৈরি করতে শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়।

টিস্যু বায়োপসি : সন্দেহভাজন টিস্যু বৃদ্ধির একটি ছোট নমুনা ডাক্তার দ্বারা এক্সাইজ করা হয় এবং কোন ক্যান্সার কোষের উপস্থিতি পরীক্ষা করার জন্য পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। এই পরীক্ষা সাধারণত স্তন ক্যান্সার বাতিল করার জন্য করা হয়।

গাইনোকোমাস্টিয়া-এর চিকিৎসা কি?

সিডো-গাইনোকোমাস্টিয়া ব্যাতীত অন্যান্য গাইনোকোমাস্টিয়ার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সার্জারি একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি। যদিও এটি শারীরিক অসুবিধার থেকে সামাজিক বিড়াম্বনাটাই বেশি। এ ক্ষেত্রে প্লাস্টিক সার্জারি করলে সাধারনত দাগ থাকে না।

গাইনেকোমাস্টিয়া কীভাবে প্রতিরোধ করবেন?

বিনোদনমূলক ওষুধের ব্যবহার এড়িয়ে চলুন, অ্যালকোহল সেবন বন্ধ করুন, ডাক্তার দ্বারা নির্ধারিত স্টেরয়েড ব্যবহার এড়িয়ে চলুন, বডি বিল্ডিং পরিপূরক এবং ওষুধ এড়ানো উচিত, একটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা, একটি সুষম খাদ্য খান, ব্যায়াম নিয়মিত করুন।

লেখক : সাবেক ডিরেক্টর মাইক্রো-সার্জিক্যাল রিসার্চ ইয়েল ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা।

সাবেক বিভাগীয় প্রধান, (বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট),

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

সিনিয়র কন্সাল্টেন্ট (প্লাস্টিক সার্জারি),

ইবনে সিনা হাসপাতাল, ধানমন্ডি।