দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে চলছে সরকারবিরোধী আন্দোলন। গত মাস থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতায় সরকারের দমন-নিপীড়নে অন্তত ৫০ জন নিহত হওয়ার জেরে আন্দোলনের তীব্রতা বেড়েছে। গত বৃহস্পতিবার কয়েক হাজার ক্ষুব্ধ জনতা রাজধানী লিমায় বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় তারা প্রেসিডেন্ট দিনা বলুয়ার্তের পদত্যাগ, সংবিধান পরিবর্তন ও আগাম নির্বাচনের দাবি জানান।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত বৃহস্পতিবারের বিক্ষোভে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ অংশ নেন বলে জানিয়েছে দেশটির পুলিশ। তবে বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি ও তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিক্ষোভকারী ছিলেন আদিবাসী অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দা।
জানা যায়, এদিন লিমার বিভিন্ন রাস্তায় নামা বিক্ষোভকারীরা নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছোড়েন। শহরের একটি ঐতিহাসিক ভবনে আগুন লাগার খবরও পাওয়া যায়। দাঙ্গাকারীদের প্রতিহত করতে মোতায়েন করা হয় দাঙ্গা পুলিশ। এদিন হাজার হাজার মানুষ পতাকা ও ব্যানার নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আয়াকুচো ও হুলিয়াকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জন্য সরকার ও পুলিশের ওপর চড়াও হয়। অস্থিরতা এরই মধ্যে রাজধানীর বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর ভিডিও প্রতিবেদনে দেখা যায়, দক্ষিণাঞ্চলীয় আরেকিপায় বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করছেন কয়েকশ’ বিক্ষোভকারী। আর তাদের লক্ষ করে কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছে পুলিশ। একপর্যায়ে কর্তৃপক্ষ পরে আরেকিপা ও কুস্কো বিমানবন্দরের যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে।
এ দুই বিমানবন্দরের পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলীয় হুলিয়াকা শহরের আরেকটি বিমানবন্দরে হামলা হয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রেসিডেন্ট বলুয়ার্তে। দাঙ্গাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে বলেও জানান তিনি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সাম্প্রতিক দাঙ্গায় এখন পর্যন্ত ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। পরিবহণ কর্মকর্তারা বলছেন, দেশটির ২৫টি অঞ্চলের ১৮টিতেই বিক্ষোভকারীরা সড়ক অবরোধ করে রাখেন। জানা গেছে, পুলিশ রাজধানী লিমার সব প্রবেশপথের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিভিন্ন দলের নেতারা বিক্ষোভকারীদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে, সামজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই দাবি করেন, লিমার ওই ভবনে আগুন লেগেছে এক পুলিশ কর্মকর্তার ছোড়া কাঁদানে গ্যাস থেকে। তবে পেরুর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। পরে কানাডাভিত্তিক খনি কোম্পানি হাডবে এক বিবৃতিতে জানায়, বিক্ষোভকারীরা পেরুতে তাদের একটি স্থাপনায় ভাঙচুর করেছেন। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ও একাধিক যানবাহণ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আলবের্তো ওতারোলা বলেন, এটা কোনোভাবেই বিক্ষোভ হতে পারে না। দাঙ্গাকারীরা আইনের শাসন ও গণতন্ত্র নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে নাশকতা চালাচ্ছেন। রয়টার্স বলছে, গত মাস থেকে পেরুতে যে ধরনের সহিংস বিক্ষোভ হচ্ছে, তা দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে দেখা যায়নি। এমনকি, এবারের বিক্ষোভে দেশটির গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র জনগণ জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ও অসমতা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন, গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। এখন তারা ১৯৯০ এর দশকে ডানপন্থি লৌহমানব নামে খ্যাত আলবের্তো ফুজিমোরির প্রণিত বাজারবান্ধব সংবিধান বদলে নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও বলুয়ার্তেকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অপসারণসহ আগাম নির্বাচন চাইছেন।
গত বছরের ডিসেম্বরে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বামপন্থি নেতা পেদ্রো ক্যাস্তিলোকে অভিসংসনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই দেশটিতে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। অভিশংসনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মেক্সিকোর আশ্রয়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন ক্যাস্তিলো। তবে সেসময় বিশ্বস্ত দেহরক্ষীরা তাকে রাজধানী লিমার মেক্সিকান দূতাবাসে আশ্রয় নিতে বাধা দেন।
ক্ষমতাচ্যুত করার পর অল্প সময়ের ব্যবধানেই ক্যাস্তিলোকে বন্দি করা হয়। এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট দিনা বোলোয়ার্তে। তারপর থেকেই কার্যত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে রয়েছে দেশটি।
৬০ বছর বয়সি দিনা পেরুর ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। তবে ক্যাস্তিলোকে ক্ষমতাচ্যুত ও গ্রেপ্তারের পর দায়িত্ব নেয়া এ নেতৃকে প্রথম থেকেই পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন বিক্ষোভকারীরা।