ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাস্তা থেকে মাদকাসক্তদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে তালেবান

রাস্তা থেকে মাদকাসক্তদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে তালেবান

কাবুলের পশ্চিম প্রান্তে পুল-এ-সুখতা নামে একটি সেতু রয়েছে। এর নিচের জায়গাটুকু নেশাখোরদের বিচরণস্থল হিসেবে কুখ্যাত। সম্প্রতি মাদকাসক্তদের বিরুদ্ধে তালেবানের কঠোর অভিযান শুরু হলে সেতুটির নিচ থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় মোহামেদ ওমরকে।

তিনি বলেন, আমি মাদক সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম সেতুর নিচে। ঠিক সেই সময় টের পেলাম, একটি হাত আমাকে পেছন থেকে ধরে ফেলেছে। ওরা ছিল তালেবানের লোক এবং আমাদের ধরতেই তারা এসেছিল।

কট্টর ইসলামপন্থি গোষ্ঠীটি ২০২১ সালের আগস্ট মাসে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরে আসার অনেক আগে থেকেই পুল-এ-সুখতার কুখ্যাতি রয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে তালেবান। তারা এই সেতু এলাকা ছাড়া কাবুলের পার্ক বা পাহাড়ের চূড়া থেকেও মাদকাসক্তদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

এদের অধিকাংশকেই প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় একটি সাবেক মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে, যেটি এখন মাদকাসক্তদের জন্য অস্থায়ী পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে।

মাদকের রাজধানী : আফগানিস্তানকে বলা হয় বিশ্বে মাদকাসক্তির রাজধানী। দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি, আর তা মধ্যে ৩৫ লাখই মাদকাসক্ত। এ তথ্য দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাদক ও আইন প্রয়োগ ব্যুরো (বিআইএনএলই)।

ওমর যেখানে আটক হয়েছিলেন, সেই পুল-এ-সুখতা সেতুর নিচে প্রায়ই দেখা যায় শত শত লোকের সমাগম। দেখা যায়, তারা চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ময়লা-আবর্জনা, সিরিঞ্জ, মানুষের মলমূত্রের মধ্যেই জটলা পাকিয়ে বসে রয়েছে। কখনো কখনো একটি-দুটি মরদেহ পড়ে থাকতেও দেখা যায়, অতিরিক্ত মাদক সেবনে যাদের মৃত্যু হয়েছে। এসব নেশাখোরদের পছন্দের মাদক হচ্ছে হেরোইন বা মেথাঅ্যামফিটামিন।

পুল-এ-সুখতা সেতুর উপর দিয়ে গেছে শহরের ব্যস্ত রাস্তা, চলছে গাড়ি-ঘোড়া, ফেরিওয়ালারা বিক্রি করছে নানা জিনিসপত্র। কিন্তু নিচের জায়গাটিতে তীব্র দুর্গন্ধ। ময়লার স্তূপের মধ্যে খাবারের আশায় ঘুরঘুর করছে কুকুর।

ওমর বলেন, আমি ওখানে যেতাম বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে আর নেশা করতে। আমার প্রাণের ভয় ছিল না। কারণ মৃত্যু তো আল্লাহর হাতে।

যেসব লোক এসব এলাকায় মাদক সেবন করতে আসে- বলা যায়, সমাজ তাদের কথা ভুলে গেছে। পূর্ববর্তী সরকারেরও অবশ্য নীতি ছিল এসব মাদকসেবীকে রাস্তা থেকে ধরে নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানো। কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার পর তারা রাস্তা থেকে মাদকাসক্তদের সরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন শুরু করেছে।

ওমরের কথায়, ওরা আমাদের পেটানোর জন্য পাইপ ব্যবহার করতো। আমি সেতু ছেড়ে যেতে চাইনি। ওদের ঠেকাতেও চেষ্টা করেছিলাম। তাতে আমার একটি আঙুল ভেঙে যায়। শেষ পর্যন্ত ওরা আমাদের তাড়িয়ে দিতে পেরেছিল।

আরও অনেকের সঙ্গে ওমরকে ধরে নিয়ে একটি বাসে তোলা হয়। তালেবান সরকার এ ঘটনার ভিডিও প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখা যায়, তালেবান সৈন্যরা সেতুর নিচে থেকে অতিরিক্ত মাদকসেবন করে মারা যাওয়া লোকদের দেহ সরিয়ে নিচ্ছে। আরও কিছু জীবিত কিন্তু সংজ্ঞাহীন লোকদের নেয়া হচ্ছে স্ট্রেচারে করে।

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র : যে নিরাময় কেন্দ্রটিতে ওমরকে নিয়ে যাওয়া হয়, তা ১ হাজার শয্যার, তবে রোগী আছে ৩ হাজার। সেখানকার পরিবেশ খুবই জরাজীর্ণ। রোগীদের সেখানে রাখা হয় মোটামুটি ৪০ দিনের জন্য, এ সময়টা তাদের একটা নিবিড় কর্মসূচির ভেতর দিয়ে যেতে হয় এবং এরপর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। তবে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে তারা যে আবার মাদক সেবন শুরু করবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তালেবান যাদের রাস্তা থেকে তুলে নিচ্ছে তাদের অধিকাংশই পুরুষ। তবে নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া লোকদের মধ্যে কিছু নারী এবং শিশুও রয়েছে।

ওমরের কথা : কাবুলের এই মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে আসা অন্য নেশাগ্রস্তদের মতোই দেখাচ্ছিল ওমরকে। তার শরীর হাড্ডিসার হয়ে গেছে, মুখ শুকনো। কর্তৃপক্ষের দেয়া যে বাদামি রঙের পোশাক তার পরনে; সেটি মনে হচ্ছে যেন গা থেকে ঝুলছে।

বিছানার একপাশে বসে তিনি বলছিলেন তার জীবনের কথা। একসময় আমি ক্যাম এয়ারের ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট ছিলাম। তখন আজ দুবাই, কাল তুরস্ক, পরশু ইরান- এ ভাবেই চলছিল জীবন। আমি পৃথিবীর নানা দেশে গেছি। কখনো কখনো প্লেনে কোনো সাবেক প্রেসিডেন্ট বা এ ধরনের ভিআইপি যাত্রীও ছিলেন। কাবুলের পতনের পর চাকরি হারান ওমর। এরপর অর্থকষ্ট আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাকে নিয়ে যায় মাদকের পথে।

আফগানিস্তানে পপি চাষ : নব্বইয়ের দশকে তালেবান যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা আফগানিস্তান থেকে পপি চাষ প্রায় পুরোপুরি উচ্ছেদ করতে পেরেছিল। কিন্তু ২০ বছরব্যাপী বিদ্রোহী তৎপরতার সময় মাদককারবার হয়ে দাঁড়ায় তাদের আয়ের অন্যতম উৎস। এখন তালেবান বলছে, তারা পপি চাষের অবসান ঘটানোর আদেশ দিয়েছে এবং এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য কঠোরভাবে চেষ্টা করছে।

কিন্তু আফগানিস্তানের অর্থনীতি এখন প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে। কারণ, আন্তর্জাতিক সাহায্য বন্ধ, নিরাপত্তা সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ, জলবায়ু-সংক্রান্ত সমস্যা এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বৃদ্ধি কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে দেশটিকে।

ভালো হওয়ার প্রতিজ্ঞা : মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে আসার পর থেকে ওমরের মধ্যে ভালো হয়ে ওঠার একটি প্রতিজ্ঞা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, আমি বিয়ে করতে চাই, পরিবার নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চাই। হাসপাতালের চিকিৎসকরা খুবই দয়ালু। তারা আমাদের ভালোর জন্য সব কিছুই করছেন।

ডাক্তারদের দৃষ্টিতে, এই কেন্দ্রে যা করা হচ্ছে তা খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের কার্যক্রম। তালেবান এখানে ক্রমাগত আরও বেশি লোক পাঠাচ্ছে এবং তাদের রাখার জায়গা করতে হিমশিম খাচ্ছেন স্টাফরা।

এক চিকিৎসক বলেন, আমরা সাহায্য চাই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন থেকে চলে গেছে, সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের সমস্যাগুলো তো চলে যায়নি।

‘এখানে যারা চিকিৎসা নিচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেকে রয়েছে যারা বুদ্ধিমান, শিক্ষিত, পেশাজীবী লোক। যারা একসময় সুন্দর জীবনযাপন করতো। কিন্তু আমাদের সামাজিক সমস্যা, দারিদ্র্য এবং কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে তারা মাদকে শান্তি খুঁজছে।’ চিকিৎসকদের ভাষ্য, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রোগীরা যে আবার মাদকসেবন শুরু করবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবু আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাদের মধ্যে একটি ভবিষ্যতের আশা জাগিয়ে তোলা। কিন্তু তেমন কোনো আশা এখন নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত