যুক্তরাষ্ট্র ঋণখেলাপি হলে ঝুঁকিতে পড়বে বিশ্ব

প্রকাশ : ২১ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সম্প্রতি যে চরম অচলাবস্থায় আটকে রয়েছে, তা কেবল মার্কিনিদের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের জন্য ঋণের যে সর্বোচ্চ সীমা (ডেবট সিলিং) বেঁধে দেয়া রয়েছে, সেটি আরো বাড়ানো হবে কি না তা নিয়ে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান দুইপক্ষই যার যার অবস্থানে অনড়। শিগগির যদি এ অচলাবস্থার সমাধান না হয়, তাহলে এর জন্য বিশ্ব অর্থনীতিকে হয়তো এ যাবৎকালের সবচেয়ে চরম মূল্য দিতে হবে। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা যদি মার্কিন সরকারকে আরো অর্থ ধার করতে দিতে রাজি না হয় বা তাদের ভাষায়- ঋণের সর্বোচ্চ সীমা না বাড়ায়, তাহলে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশ ৩১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ঋণখেলাপি হবে। এ নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানোর সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আগামী ১ জুনের মধ্যে যেভাবেই হোক এই অচলাবস্থার নিরসন করতে হবে। যদি তা না হয়, তার পরিণতি মারাত্মক বিধ্বংসী হবে বলে সতর্ক করেছেন ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ঋণখেলাপি হলে এর কী প্রভাব পড়বে মার্কিন অর্থনীতিতে? এতে বিশ্ব অর্থনীতিরই বা কী সমস্যা?

যুক্তরাষ্ট্রে আইন করে নির্দিষ্ট করা রয়েছে, সরকার সর্বোচ্চ কী পরিমাণ অর্থ ধার করতে পারবে। দেশটিতে এ বিষয়টি প্রথম চালু হয় ১৯১৭ সালে। তখন এর লক্ষ্য ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সরকারকে অর্থ ধার করার জন্য অনেক বেশি সুযোগ করে দেয়া। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক মেরুকরণ তীব্র হয়ে ওঠার পর ঋণের সর্বোচ্চ সীমা নিয়ে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের মধ্যে মারাত্মক বিভেদ তৈরি হয়েছে। একইসঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঋণের পরিমাণও বাড়ছে, গত এক দশকে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

মার্কিন সরকারের ব্যয়ের বড় খাতগুলো হচ্ছে ফেডারেল সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, সামরিক ব্যয়, সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি। এর সঙ্গে রয়েছে সরকারের জাতীয় ঋণের কিস্তি এবং এর সুদ পরিশোধ ও ট্যাক্স রিফান্ড ইত্যাদি।

গত কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা বাড়ানো হচ্ছে। কারণ দেশটির সরকার যা আয় করছে, ব্যয় করছে তার চেয়েও বেশি।

তাদের ঋণ করার সর্বোচ্চ সীমা এখন বেঁধে দেওয়া রয়েছে ৩১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু গত জানুয়ারি মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণ এই সীমায় পৌঁছে গেছে। আপাতত মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় অন্য কিছু উপায়ে সরকারকে বাড়তি অর্থ জোগান দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়ালেন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, সরকার যদি আরও অর্থ ধার করতে না পারে, তাহলে ১ জুনের মধ্যে এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে, যার ফলে সরকার হয়তো আর তার ধার-দেনা-দায় পরিশোধ করতে পারবে না। বলে নেয়া ভালো, বিবিসি এ বিষয়ে যতজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে, তারা কেউই মনে করেন না, যুক্তরাষ্ট্র শেষপর্যন্ত ঋণখেলাপি হবে।

যদি ঋণখেলাপি হয়, তখন কী হবে?

ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ‘প্যানমিউর গর্ডনের’ প্রধান অর্থনীতিবিদ সাইমন ফ্রেঞ্চ বলেন, যদি এমন কিছু সত্যিই ঘটে, তখন এই বিপর্যয়ের তুলনায় ২০০৮ সালের বিশ্ব ব্যাংকিং এবং আর্থিক সংকটকে সামান্য বিষয় বলে মনে হবে। ১৫ বছর আগে ওই সংকটের সময় বিশ্বের বড় বড় বহু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে মারাত্মক মন্দা দেখা দিয়েছিল।

যদি যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের ঋণের সর্বোচ্চ সীমা বাড়ানো না হয়, তখন সরকার আর নতুন করে অর্থ ধার করতে পারবে না। এর ফলে দ্রুত সরকারের হাতের অর্থ ফুরিয়ে যাবে, তারা আর দায়-দেনা পরিশোধ করতে পারবে না, জনগণকে যেসব সুযোগ-সুবিধা-সেবা দিতে হয়, সেগুলোও অব্যাহত রাখতে পারবে না। তখন সরকার বাধ্য হবে জনগণকে কল্যাণ ভাতা এবং অন্যান্য যে সুযোগ-সুবিধা দেয়, তা বন্ধ করতে। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে, মানুষ তাদের ব্যয় মেটাতে পারবে না। পরিণামে মার্কিন অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগবে, বলেন এ জে বেল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ইনভেস্টমেন্ট ডিরেক্টর রাস মোল্ড।

হোয়াইট হাউজের ‘কাউন্সিল অব ইকনোমিক অ্যাডভাইজার্স’ হিসাব করে দেখেছে, সরকার যদি দীর্ঘসময় পর্যন্ত ঋণের সীমার ব্যাপারে কোনো সমাধানে পৌঁছাতে না পারে, মার্কিন অর্থনীতি ৬ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন্স কলেজের প্রেসিডেন্ট এবং খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ আল-এরিয়ান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি ঋণখেলাপি হয়, তখন পুরো মার্কিন অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেবে। এর প্রভাব গিয়ে পড়বে বাকি বিশ্বে। যেমন- যুক্তরাজ্যে, যারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিপুল ব্যবসা-বাণিজ্য করে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বিশ্বজুড়ে সব দেশের সঙ্গেই ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় অংশীদার। মন্দায় পড়লে তারা বাকি বিশ্ব থেকে জিনিসপত্রও কম কিনবে।

বাড়ি কেনার ঋণের খরচ বাড়বে

যুক্তরাষ্ট্র ঋণখেলাপি হওয়ার মানে কেবল ব্যবসা-বাণিজ্যেই মন্দা নয়, এর প্রভাব পড়বে বাড়ি কেনার ঋণ থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছুর ওপর। ফ্রেঞ্চ বলেন, এর ফলে যুক্তরাজ্যে বাড়ি কেনার ঋণের খরচ বেড়ে যাবে, বাড়বে বেকারত্ব। এটি হবে রীতিমতো এক প্রলয়-কাণ্ড। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে যুক্তরাজ্যে বাড়ি কেনার ঋণের খরচ কেন বাড়বে?

কোনো সরকার যখন অর্থ ধার করতে চায়, তারা বন্ড বিক্রি করে। যুক্তরাষ্ট্রে এই বন্ডের নাম ‘ট্রেজারি বন্ড’, আর যুক্তরাজ্যে বলা হয় ‘গিল্ট’। একজন বিনিয়োগকারী যখন সরকারের কাছ থেকে এ ধরনের বন্ড বা গিল্ট কেনেন, তখন তিনি বিনিয়োগ করা অর্থের জন্য সরকারের কাছ থেকে সুদ পান।

কিন্তু মার্কিন সরকার যদি ঋণ পরিশোধ না করে বা সুদের অর্থ পরিশোধ না করে, তখন বিনিয়োগকারীরা ভাববে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ঋণখেলাপি হতে পারে, তাহলে ব্রিটিশ সরকারও যে হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাজ্যে সরকারি বন্ড কেনার জন্য আরো বেশি সুদ দাবি করবে। ফ্রেঞ্চ বলেন, যে কোনো ঋণের সুদের হার নির্ধারিত হয় এই ঋণ দেয়ার ঝুঁকি কতটা তার ওপর ভিত্তি করে। সেটি বাড়ি কেনার জন্য দেয়া ঋণই হোক বা সরকারের ধার করা। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের সরকার যখন ঋণখেলাপি হবে, সেটি বিরাট বড় এক ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াবে এবং তখন রাতারাতি সব ধরনের ঋণের সুদের হার অনেক বেড়ে যাবে।

জিনিসপত্রের দাম বাড়বে

মার্কিন ডলার হচ্ছে গোটা বিশ্বের জন্য রিজার্ভ মুদ্রা। এর মানে, সারা বিশ্বে যত ধরনের পণ্যের লেনদেন হয়, যেমন- জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে গমণ্ড সবকিছুর দাম নির্ধারিত হয় ডলারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সরকার যদি ঋণখেলাপি হয়, সঙ্গে সঙ্গে ডলারের দাম নাটকীয়ভাবে পড়ে যাবে।

মনে হতে পারে, এটি তো বাকি বিশ্বের জন্য ভালো খবর। কিন্তু ফ্রেঞ্চ বলেন, এর মানে হচ্ছে, যারা বিশ্বে পণ্যের বাজারে বিনিয়োগ করে, তারা তখন জানবে না কীভাবে তাদের পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। তিনি বলেন, যখন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এভাবে ঋণখেলাপি হবে, তখন হঠাৎ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হবে। তারা প্রশ্ন করতে শুরু করবে, এরপর কি জাপান? যুক্তরাজ্যেও কি একই ঘটনা ঘটবে? তারপর কি জার্মানি? এরপর আর কারা ঋণখেলাপি হবে? তখন আমাদের সবকিছুর দাম নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে। অর্থনীতির পরিভাষায়, এর নাম রিস্ক প্রিমিয়াম, অর্থাৎ বাড়তি ঝুঁকি। তখন সব কিছুর দামের মধ্যে এই বাড়তি ঝুঁকির খরচ যুক্ত হবে। কাজেই রুটির দাম পর্যন্ত বেড়ে যাবে। খাদ্য থেকে শুরু করে জ্বালানি তেল- সবকিছুর দাম বেড়ে গেলে কোটি কোটি মানুষের জীবনধারণের ব্যয়ও অনেক বেড়ে যাবে।

কমবে পেনশন : মোল্ড জানান, বিশ্বের শেয়ারবাজারের ৬০ শতাংশই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। কাজেই পেনশন তহবিলের যে অর্থ মার্কিন শেয়ারে বিনিয়োগ করা রয়েছে, সেগুলো ঝুঁকিতে পড়বে। লোকে হয়তো জানেই না তাদের পেনশনের অর্থ সেখানে বিনিয়োগ করা। আর যুক্তরাষ্ট্র ঋণখেলাপি হলে শেয়ারবাজারে তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবেই। ২০১১ সালেও ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানরা ঋণের সর্বোচ্চ সীমা নিয়ে এ ধরনের অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন। সেই অচলাবস্থার নিরসন হয়েছিল ঋণখেলাপি হওয়ার সময়সীমা ঘনিয়ে আসার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। তখন মার্কিন শেয়ারবাজারে ধস নেমেছিল। তবে এই আতঙ্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নাটকীয়ভাবে পড়ে যাওয়া শেয়ারবাজার আবার দ্রুতই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। মোল্ড মনে করেন, এবারও হয়তো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। সূত্র: বিবিসি বাংলা