ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভারত-পাকিস্তানে নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে ডিপফেক ব্যবহারের জোয়ার

ভারত-পাকিস্তানে নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে ডিপফেক ব্যবহারের জোয়ার

দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল দেশ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। চলতি বছরের প্রথমার্ধেই দেশগুলোতে জাতীয় নির্বাচন হবে। তিনটি দেশই ভূরাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণে ঐতিহাসিকভাবে সংযুক্ত। এই সংযুক্তিতে নতুন আরেকটি দিক যুক্ত হয়েছে, যেটি সব দেশকেই ভাবিয়ে তুলেছে। সেটি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেতিবাচক ব্যবহার। আরো স্পষ্ট করে বললে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ডিপফেক প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। ভারতীয় প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ দিব্যেন্দ্র সিং জাদন চলচ্চিত্র জগতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট তৈরির কাজ করেন। কিছুদিন আগে তিনি ভারতীয় রাজনীতিবিদদের হয়ে কাজ করার ডাক পান। তাকে যে ধরনের কাজ করতে বলা হয়েছিল, তার মধ্যে নির্বাচনি প্রচারণাকে কেন্দ্র করে এআই ভিডিও ও ডিপফেক অডিও-ভিডিও তৈরি উল্লেখযোগ্য। গত নভেম্বরে নিজ রাজ্য রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচন ছিল। সেখানে তাঁর কাজ করার ব্যাপক সুযোগ থাকার পরও তিনি প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দেন। জাদুন পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য ডনকে বলেন, ‘ডিপফেক তৈরির প্রযুক্তি এখন খুবই দুর্দান্ত। এটি খুব সহজেই ও খুব দ্রুত করা যায়। সাধারণ লোকজন ধরতেও পারে না বিষয়টি আসল নাকি নকল।’ জাদুন বলেন, ডিপফেক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কোনো আইনি নির্দেশনা নেই। এ কারণে বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। ডিপফেক এমন প্রযুক্তি এবং এটিকে এমনভাবে ম্যানিপুলেট করা যায়, যার মাধ্যমে ব্যক্তির ভোট দেওয়া প্রভাবিত করা যাবে। ডিপফেকের সাম্প্রতিক অনেকগুলো উদাহরণ আছে। যেমন, ইনস্টাগ্রামে ভাইরাল হওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আঞ্চলিক ভাষার গান, টিকটকে ভাইরাল হওয়া ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী প্রোবো সুবিয়ান্তো ও আনিস বাসবেদানের সাবলীল আরবি কথোপকথন ইত্যাদি। এসব ভিডিওর সবই এআই ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে এবং কোনো ধরনের শনাক্তকরণ চিহ্ন ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ায় নির্বাচন সামনে রেখে ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গুজব, ভুয়া তথ্য ছড়ানোর বিষয়টি ব্যাপক হারে বাড়ার আশঙ্কা করছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। এই দেশগুলো ব্যাপক জনবহুল হওয়ায় ডিপফেক প্রযুক্তি জনমত নির্ধারণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। এরই মধ্যে দেশগুলোর কর্তৃপক্ষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে সতর্ক করেছে যে, তারা যদি তাদের প্ল্যাটফর্মে তৃতীয় পক্ষের ভুয়া কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, তাহলে সাধারণ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারে। পাকিস্তানের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল রাইটস ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা নিঘাত দাদ বলেন, ‘ভুয়া তথ্য পাকিস্তানের নির্বাচন ও সমগ্র গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য যে হুমকি সৃষ্টি করেছে, তা সহজে বলে শেষ করা যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘অতীতেও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ভুল তথ্য ভোটারের আচরণ, দলীয় সমর্থন এমনকি আইন পরিবর্তনকে প্রভাবিত করেছে। সিনথেটিক মিডিয়া এটিকে আরও সহজ করে তুলবে।’

শুধু পাকিস্তানেই নয়, ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচনকে প্রভাবিত করতেও ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে দেশটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গুজব নিয়ে গবেষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নুরিয়ান্তি জল্লি। তিনি বলেন, আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীকারী তিনজনেরই ডিপফেক কনটেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। নুরিয়ান্তি জল্লি বলেন, ‘ভোটারদের ব্যক্তি পর্যায়ে ভুল তথ্য থেকে শুরু করে মিথ্যা আখ্যান দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার মতো এআইয়ের সক্ষমতা রয়েছে, যা মানুষের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই টুলগুলো ভোটারদের ধারণা ও আচরণকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে।’ কেবল ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা ইন্দোনেশিয়ায় নয়; গত বছরে অনুষ্ঠিত তুরস্ক, নিউজিল্যান্ড এবং আর্জেন্টিনার নির্বাচনেও এআই-কেন্দ্রিক ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। চলতি বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও এই প্রযুক্তি প্রভাব বিস্তার করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। মার্কিন থিংকট্যাংক ফ্রিডম হাউসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এআই ভুয়া তথ্য তৈরি, ছড়িয়ে দেওয়াকে আগের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুততর, সস্তা ও আরো বেশি কার্যকর করে তুলেছে। বাংলাদেশেও ডিপফেক প্রযুক্তির অপব্যবহারের বিষয়টি বেশ বেড়েছে। সম্প্রতি বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানাকে বিকিনি পরিহিতা ও দলটির আরেক নেত্রীয় নিপুণ রায় চৌধুরীকে সুইমিং পুলে দেখানো হয়, যা আসলে ডিপফেক প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরি।

বাংলাদেশে ডিপফেক প্রযুক্তির বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সাঈদ আল-জামান দ্য ডনকে বলেন, এ বিষয়গুলো খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং এখনো ছড়াচ্ছে। তার মতে, নিম্নমানের ডিপফেকও মানুষের চিন্তাকে ভুল পথে প্রবাহিত করতে পারে। সিনথেটিক মিডিয়া শনাক্তকারী টুল নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ডিপমিডিয়া জানাচ্ছে, ২০২৩ বিশ্বজুড়ে অন্তত ৫ লাখ ডিপফেক ভিডিও ও অডিও শেয়ার হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্ল্যাটফর্মগুলো এ ধরনের কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের মালিক প্রতিষ্ঠান মেটা জানিয়েছে, তারা তাদের প্ল্যাটফর্মগুলোতে ছড়িয়ে পড়া সিনথেটিক মিডিয়াগুলো অপসারণে বদ্ধপরিকর। বিশেষ করে ফেক ভিডিওগুলোর ক্ষেত্রে।

টেক জায়ান্ট ওই ইউটিউবের মাতৃপ্রতিষ্ঠান গুগল গত নভেম্বরে বলেছে, ‘যদি কোনো ভিডিও নির্মাতা সিনথেটিক ভিডিও প্রকাশ করতে চান, তাহলে আমাদের আগে অবহিত করতে হবে। আমরা দর্শকদের আগে থেকেই সে বিষয়ে অবগত করব।’ অ্যাডভোকেসি গোষ্ঠী অ্যাকসেস নাউয়ের এশিয়া চ্যাপ্টারের পলিসি ডিরেক্টর রমণ জিৎ সিং চিমা বলেন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো সম্প্রতি অনলাইন কনটেন্টকে আরো নিবিড়ভাবে নজরদারিতে রাখার জন্য আইন পাস করেছে। দেশগুলো ভুল তথ্য হিসেবে বিবেচিত- এমন বিষয়বস্তু প্রচারের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে দায়ী করার প্রয়াস পেয়েছে, তাই প্ল্যাটফর্মগুলোও এখন তুলনামূলক শিথিল আচরণ করেছে।’

এসব দেশে এ ধরনের সমস্যা দেখভাল করার জন্য সামাজিক মাধ্যমগুলো খুব একটা সক্রিয় নয়। চিমার মতে, এটি খুবই বিপজ্জনক লক্ষণ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত