ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কোন পথে যুক্তরাষ্ট্র, সংঘাত কি আসন্ন?

কোন পথে যুক্তরাষ্ট্র, সংঘাত কি আসন্ন?

‘সাপে-নেউলে’ সম্পর্ক ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে, যা চলছে ১৯৫০ এর দশক থেকে। বৈরিতা বাড়ছে দিন দিন। হচ্ছে জটিল থেকে জটিলতর কূটনৈতিক সম্পর্ক। সম্প্রতি ড্রোন হামলায় তিন মার্কিন সেনা নিহতের ঘটনায় আবারও আলোচনায় এসেছে ওয়াশিংটন-তেহরানের সম্পর্ক। ইরান সমর্থিত কট্টর উগ্রগোষ্ঠীকে হামলার জন্য দায়ী করে ইরানকে পাল্টা জবাব দেওয়ার কথা জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরানও। বলছে- ইরানের ওপর কোনো আক্রমণ হলে পাল্টা আক্রমণ করা হবে যুক্তরাষ্ট্রে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, কোন পথে যাচ্ছে ওয়াশিংটন-তেহরান, সংঘাতে জড়াবে দুই দেশ? যদিও মার্কিন সেনা ঘাঁটিতে হামলার পর দুই দেশই জানিয়েছে ‘যুদ্ধ’ চায় না তারা। তবে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করছেন মধ্যপ্রাচ্যে টানা হামলা ও ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশ দু’টি ‘সংঘাতের দিকে হাঁটছে’।

সাম্প্রতিক উত্তেজনা কেন? গেল রোববার, অর্থাৎ ২৮ জানুয়ারি সিরিয়ার সীমান্তবর্তী জর্ডানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রুকবানে এক মার্কিন ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালানো হয়। এতে নিহত হন তিন মার্কিন সেনা। এছাড়া আহত হয়েছেন অন্তত ৩৪ সৈন্য। হামলার পেছনে কারা জড়িত সেটি স্পষ্ট না হলেও শুরু থেকেই সেন্ট্রাল কমান্ড ও বাইডেন প্রশাসন দায়ী করছে ইরানকে। যদিও ইরান তাদের এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ড্রোনটি আগে একটি বাসস্থানে পড়ার পর ঘাঁটিতে এসে পড়ে। এটি যদি সরাসরি আঘাত করতো, তাহলে হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি হতো। যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সিবিএস নিউজ জানিয়েছে, ‘টাওয়ার ২২’ ঘাঁটিতে হামলায় যে ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে, তা ইরানে নির্মিত বলে মনে হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা ইঙ্গিত করেছেন, এটা ‘শাহেদ ড্রোনের ধরন’, যা মূলত একমুখী হামলার ড্রোন। এই ড্রোন মস্কোকে দিয়েছিল ইরান। জর্ডান দাবি করছে, ড্রোন হামলাটি সিরিয়ায় হয়েছে, জর্ডানের ভেতর নয়। এই অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটিতে এর আগেও হামলা হয়েছে, তবে কখনও মার্কিন সেনাদের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তিন মার্কিন সেনা নিহতের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে জবাব দেবে, সে বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইঙ্গিত দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, আমি মনে করি না, মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের ব্যাপক পরিসরে যুদ্ধ করার প্রয়োজন আছে। ইরান-সমর্থিত এক মিলিশিয়া গ্রুপ মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে এই হামলার দায় স্বীকার করলেও এই ঘটনায় ইরানকে দায়ী করা যায় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই অর্থে আমি তাদের (ইরান) দায়ী মনে করি যে, যারা এসব করেছে, তাদের তারা অস্ত্র সরবরাহ করছে। গত মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) সকালে হামলার জবাব নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কি না- প্রশ্নে সম্মতিসূচক জবাবে তিনি ‘হ্যাঁ’ বলেন। এর আগে হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, এ হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে উপযুক্ত সময়ে এবং উপায়ে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা নেবে। সবকিছুর জন্য যারা দায়ী তাদের জবাবদিহি করতে হবে এবং তা আমাদের ঠিক করা উপায়েই করতে হবে। তবে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র এর জবাব দেবে, সে বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন কিছুই জানাননি। যদিও পেন্টাগনের মুখপাত্র সাবরিনা সিং জানিয়েছিলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না, কিন্তু আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো এবং আমাদের বাহিনীর ওপর হামলার উত্তর দেবো।

ইরানের পাল্টা হুঁশিয়ারি : ড্রোন হামলায় ইরান সমর্থিত গ্রুপগুলোকে দায়ী করলেও শুরু থেকেই হামলায় সন্দেহভাজন গোষ্ঠীগুলোর সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইরান। তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের ওপর আক্রমণ করে, তাহলে তেহরানও মধ্যপ্রাচ্যে থাকা মার্কিন সম্পত্তির ওপর হামলা চালাবে; মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছে। জর্ডানে মার্কিন সেনা নিহতের ঘটনায় বাইডেনের প্রতিক্রিয়া কী হয় সেদিকে নজর রাখছে। গত বুধবার ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত নিউজ নেটওয়ার্ক প্রেস টিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জাতিসংঘে ইরানের স্থায়ী মিশন যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করে বলেছে ইরান ও তার জনগণের বিরুদ্ধে যে কোনো আগ্রাসনের কঠোর জবাব দেওয়া হবে।’

এছাড়া হামলার ঘটনার পর দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি ইরানের বার্তা সংস্থা ইরনাকে বলেছিলেন, এই অঞ্চলের বাস্তবতাকে আমলে না নিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তোলা হচ্ছে। গাজায় হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা চলছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান সমর্থিত বিভিন্ন সশস্ত্রগোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলায় চালিয়ে আসছে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সশস্ত্রগোষ্ঠীগুলোর ঘাঁটি লক্ষ্য করে বিমান হামলার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। বিশ্লেষকরা মনে করেন- সবশেষ জর্ডানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ড্রোন হামলায় তিন সেনাসদস্য নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও কঠোর আকার ধারণ করেছে। দুই দেশই পরস্পরকে দোষারোপ ও হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইরানের বিরুদ্ধে কোনো বড় আকারের যুদ্ধের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন তবু এই পরিস্থিতি এখানেই থামছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি থমাস শ্যানন এনবিসি নিউজকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন ধীরে ধীরে ইরানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করা থমাস শ্যানন মনে করেন, ইরান তার সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনী ব্যবহার করে পশ্চিমা স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও ইরান প্রায়ই বলে, এই গোষ্ঠীগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর তাদের কোনো প্রভাব নেই। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরাও স্পষ্ট নন। তবে এই অস্পষ্টতাকেই বড় করে দেখছেন শ্যানন। বলছেন, এটি হিসাবের গড়মিল ও উত্তেজনার তীব্রতা বাড়িয়ে তোলার ঝুঁকি তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিংকেন মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে ‘অবিশ্বাস্যভাবে অস্থির’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, অন্তত ১৯৭৩ সালের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এত বিপজ্জনক পরিস্থিতি বিশ্ব দেখেনি। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন আলোচনায় নিযুক্ত ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিশেষ দূত ফ্রাঙ্ক লোয়েনস্টেইন। এই হামলার ঘটনাগুলো কতখানি ইরানে প্ররোচণায় হচ্ছে সেটি শতভাগ নিশ্চিত না হলেও তিনি বলছেন, এ ধরনের কয়েক ডজন হামলা তারা আগেও চালিয়েছে। কিন্তু এর আগে তারা কখনো কোনো মার্কিন সেনাকে হত্যা করেনি। শেষ পর্যন্ত এই দফায় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান কোনো যুদ্ধের দিকে গড়াবে কিনা সেটি স্পষ্ট না হলেও মার্কিন সেনা নিহত হওয়ায় এই উত্তেজনা সহসা থামছে না এমন ইঙ্গিতই করছেন বিশ্লেষকরা।

ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতার ইতিহাস :

ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতার শুরু হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। ওই সময় ইরানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদেক তেল সম্পদকে সরকারীকরণ করতে চেয়েছিলেন। কারণ, এর বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করত ব্রিটিশরা এবং বেশিরভাগ ইরানি সেখান থেকে কোনো সুবিধা পেতো না। কিন্তু এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। মনে করা হয় যে এই অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন ও ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের ভূমিকা ছিল। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে মোহাম্মদ রেজা শাহ ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং সাভাক নামক গোপন পুলিশ বাহিনী দিয়ে তার বিরোধিতাকারীদের দমন করেন। তখন ইসলামপন্থী নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি তার প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে যান। তবে শাহের বিরোধিতা করার পর তিনি নির্বাসনে ছিলেন। কিন্তু ৭০ এর দশকে ইরানের জনগণের বড় অংশ শাহের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৭৯ সালে প্যারিস থেকে খামেনি আবার ইরানে ফিরে আসেন। সে বছর থেকেই খামেনি হয়ে উঠলেন দেশটির প্রথম ‘সুপ্রিম লিডার’। সে সময় নতুন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে আমেরিকাবিরোধী মনোভাব তুঙ্গে ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে খামেনিপন্থী ছাত্ররা তেহরানের মার্কিন দূতাবাসে ঢুকে পড়ে। ৫২ জন আমেরিকানকে ৪৪৪ দিন জিম্মি করে রাখে। এই ঘটনায় প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধ শুরু হয়। ইরানে হামলার মাধ্যমে তিক্ত এক যুদ্ধ শুরু করে ইরাক। সেই যুদ্ধে ইরাককে নানাভাবে সাহায্য করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ধারণা করা হয়, সেই যুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা গেছে। টানা ৮ বছর পর একটা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন খামেনি। এরপর এই দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ত হতেই থাকে। তেহরান ইঙ্গিত দেয়, আমেরিকা এবং ইসরায়েল তাদের প্রধান শত্রু।

১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি যুদ্ধজাহাজ গুলি করে তেহরানের একটি বিমানকে ভূপাতিত করে। এটাকে ভুল হিসেবে স্বীকার করলেও এর জন্য কখনও ক্ষমা চায়নি যুক্তরাষ্ট্র। ২০০০ সালের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের নজর পড়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর। তখন আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ায় ইরানের তেল রফতানি ও অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়ে। ২০১৫ সালের চুক্তির আলোকে ইরান তাদের পরমাণু কার্যক্রম সীমিত করতে সম্মত হয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের পরিদর্শনের অনুমতি দিয়েছিল। তবে শর্ত ছিল যে ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ান। সে সময় তিনি বলেন, পরমাণু কর্মসূচি কমিয়ে আনা ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি স্থগিত করতে ইরানকে একটি নতুন চুক্তিতে বাধ্য করবেন। ইরান তার এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে এবং ঘোষণা করে যে তারা আর ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধ মানবে না। এরপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ২০২০ সালে ইরাকে মার্কিন ড্রোন হামলায় হত্যা করা হয় ইরানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সামরিক কমান্ডার কাসেম সোলেইমানিকে। এই হত্যাকাণ্ডের পর দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে এবং এই উত্তেজনার সাথে নতুন করে যোগ হলো টাওয়ার ২২-এ হামলার কারণে এই তিন মার্কিন সেনা সদস্যের নিহত হওয়ার ঘটনা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত