ভারতে মুসলিম ও বিরোধী রাজনীতিকদের প্রবল আপত্তির মুখে লোকসভায় পাস হয়েছে বিতর্কিত ওয়াকফ বিল। বুধবার গভীর রাতেই বিলটি লোকসভায় পাস হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদের উচ্চকক্ষেও তা পাস হয়ে যাওয়ায় বিলটির আইনে পরিণত হওয়া শুধু এখন সময়ের অপেক্ষা। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু সই করলেই বদলে যাবে ৭০ বছরের পুরোনো আইন। ১৯৫৪ সালের আইনকে সংশোধন করে ১৯৯৫ সালে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা অনেকটাই বাড়িয়েছিল ভারত সরকার। কিন্তু ৩০ বছর পরে যে সংশোধনে সিলমোহর দিল ভারতীয় সংসদ, তাতে বোর্ডের ক্ষমতা এবং কার্যকারিতার হস্তক্ষেপে বদলে যেতে চলেছে সেই আইন।
ভারতের বিরোধী দলেরই দাবি, ওয়াকফ আইনের এই সংশোধন ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতাকে বেনজির ভাবে খর্ব করে দিচ্ছে। সমস্ত বিতর্ক এবং সংশোধনী নিয়ে ভোটাভুটি শেষে বৃহস্পতিবার রাত ২টা ১৯ মিনিটে ‘ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৫’ পাশ করানোর প্রস্তাব পেশ করেন সংসদীয় বিষয়ক এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। ধ্বনিভোটের ফলাফলে বিরোধী শিবির সন্তুষ্ট হয়নি। তারা বিভাজন (ডিভিশন) চান। ভোটাভুটি শেষে রাত ২টা ৩৪ মিনিটে ফল ঘোষিত হয়। তাতে দেখা যায় বিলের পক্ষে পড়েছে ১২৮টি ভোট। আর বিপক্ষে পড়েছে ৯৫টি ভোট। ৩৩ ভোটের ব্যবধানে ওয়াকফ বিল রাজ্যসভায় পাশ হয়ে যায়। বিতর্ক চলে ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা নাগাদ রাজ্যসভায় ওয়াকফ বিল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সংসদীয় বিষয়ক এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজুর ভাষণের মাধ্যমেই আলোচনা তথা বিতর্কের সূত্রপাত। রিজিজুর দাবি, ওয়াকফ সম্পত্তির অন্যতম লক্ষ্য হলো সেই সম্পত্তির মাধ্যমে মুসলিম সমাজের গরিব, মহিলা ও অনাথ শিশুদের উন্নয়ন। নতুন আইনে বিপুল রাজস্ব আদায় হবে বলেও রিজিজু সংসদে দাবি করেন। তার অভিযোগ, রাজস্ব সংগ্রহ করতে ‘ব্যর্থ’ হয়েছে ওয়াকফ বোর্ড। ২০০৬ সালে সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৫ লাখ ওয়াকফ সম্পত্তি ছিল। এখান থেকে আয় হওয়া উচিত ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। হয়েছে মাত্র ১৬৩ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে ইউপিএ সরকার ওয়াকফ আইনে কিছু পরিবর্তন আনে। কিন্তু তাতেও সে সময়ে ৮ লাখ ৭২ হাজার ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে আয় ছিল মাত্র ১৬৬ কোটি টাকা। কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে স্থির হয়েছিল, রাজ্যসভায় এই বিলের ওপরে ৮ ঘণ্টা আলোচনা চলবে। সেই সময়সীমা অনুসারে রাত ৯টায় আলোচনা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকার ও বিরোধী পক্ষের অনেক সাংসদই এই আলোচনায় অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায় সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। রাত ১টা ১১ মিনিট পর্যন্ত চলে আলোচনা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবেগৌড়াও বৃহস্পতিবার ওয়াকফ বিল-বিতর্কে অংশ নেন। নবতিপর দেবেগৌড়াকে দীর্ঘ দিন পরে সংসদে ভাষণ দিতে দেখা যায়। শারীরিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে তার আসনে বসেই ভাষণ দেয়ার অনুমতি দেন চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়। দেবেগৌড়া ওয়াকফ বিলকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, এই বিল গরিব মুসলিমদের রক্ষা করবে তাদেরই ধনী অংশের হাত থেকে। ন্যায়ের স্বার্থে এই নতুন বিল আমাদের সংবিধানের বুনিয়াদি নীতিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, ‘এ কথা মনে রাখতে হবে যে, নতুন ওয়াকফ বিল মুসলিমদের ধর্মাচরণে কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করছে না। দেশে যে বিপুল পরিমাণ ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যেই এই বিল আনা হয়েছে বলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন।
রাত ১২টা ৫৫ নাগাদ সংসদীয় বিষয়ক এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী গোটা বিতর্কের ওপরে জবাবি ভাষণ দেয়া শুরু করেন। যদিও সে ভাষণের শুরুতেই রিজিজু বলে দেন, তিনি খুব বিশদে উত্তর দেবেন না। কারণ ওয়াকফ বিল নিয়ে ভোটাভুটির পরে অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও রাজ্যসভায় উঠবে। ১৬ মিনিটের ভাষণের শেষে রিজিজু সিএএ পাস হওয়ার আগের এবং পরের পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ বলছেন, আমরা এই বিলের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের ভয় দেখাচ্ছি। কিন্তু ভয় আমরা দেখাচ্ছি না। ভয় আপনারা দেখাচ্ছেন। সিএএর সময়েও অনেকে ভয় দেখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সিএএ পাস হলেই অনেকের নাগরিকত্ব চলে যাবে। কিন্তু সিএএ পাস হওয়ার পরে তেমন কিছু হয়নি। ওয়াকফ বিলের ক্ষেত্রেও আগে থেকে অনেকে ভয় দেখানোর কাজ করছেন। কিন্তু বিল পাস হওয়ার পর দেখবেন, আগামীকাল থেকেই একে কীভাবে স্বাগত জানানো হয়।’ নতুন আইনে কেন ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে, এই প্রশ্ন বিরোধী শিবির থেকে অনেকেই তুলেছিলেন। সে প্রশ্নের জবাবে রিজিজু বলেন, ‘ওয়াকফ বোর্ড একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা। একটি বিধিবদ্ধ সংস্থায় শুধু মুসলিমরা থাকবেন, আর কেউ থাকতে পারবেন না, এটা কীভাবে হবে?’ রিজিজুর কথায়, ‘বিধিবদ্ধ সংস্থাকে ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে এবং সব ধর্মের প্রতিনিধিত্ব সেখানে থাকা উচিত।’ তবে রিজিজু এ-ও জানান যে, ২২ সদস্যের বোর্ডে সর্বোচ্চ চারজন অমুসলিম সদস্য থাকতে পারবেন। ফলে বিল পাস হয়ে তা আইনে পরিণত হলেও ওয়াকফ বোর্ডে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠই থাকবেন।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএর চেয়ে ‘ইন্ডিয়া’ সংখ্যায় বেশ পিছিয়ে থাকলেও ‘জাদুসংখ্যা’ এনডিএর হাতেও নেই। তাই লোকসভায় যতটা মসৃণ ভাবে বিলটি পাস হয়েছিল, রাজ্যসভাতেও ততটা সহজে হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল।