ঢাকা ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মসজিদুল আকসার তাৎপর্য

মসজিদুল আকসার তাৎপর্য

মসজিদুল আকসা মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ের স্পন্দনের নাম। মক্কা-মদিনার পর এই মসজিদের নাম শুনলে আমরা যতটা আপ্লুত হই, অন্য কোনো মসজিদের নাম শুনলে ততটা হই না। এটা আমাদের প্রথম কিবলা। ইসলামের ইতিহাসের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এই মসজিদ ঘিরে। শুধু তাই নয়, কেয়ামতের আগে অসংখ্য বিস্ময়কর ঘটনা সংঘটিত হবে এই মসজিদ ও তার আশপাশের অঞ্চলে। মসজিদুল আকসা আমাদের অনুপ্রেরণার নাম। মসজিদুল আকসার কথা ভাবলেই আমাদের স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে খলিফা ওমর (রা.) ও সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের ইতিহাস। মসজিদুল আকসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাসুলের (সা.) মেরাজের স্মৃতি। নানা কারণেই মসজিদুল আকসার প্রসঙ্গ এলে আমরা আবেগতাড়িত হই, আমাদের চোখ সজল হয়ে ওঠে। আজ আমরা কোরআন-সুন্নাহর দলিলের আলোকে মসজিদুল আকসার ১১টি অনন্য তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করব, যা একদিকে আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে, পাশাপাশি এই মসজিদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে ইনশাআল্লাহ।

প্রথম কিবলা : একজন মুসলমানের ধর্মকেন্দ্রীক যে কয়টি আবেগের জায়গা রয়েছে, কিবলা তার অন্যতম। কিবলার সঙ্গে আমাদের আবেগ ও ভালোবাসা জড়িত। কিবলার দিকে ফিরে আমরা নামাজ পড়ি, কিবলাকে আমরা হৃদয় থেকে শ্রদ্ধা করি। আর মসজিদুল আকসা আমাদের প্রথম কিবলা। ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে রাসুলের (সা.) ওপর যখন নামাজ ফরজ হয়, তখন তিনি ও সাহাবীরা মসজিদুল আকসার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতেন। মদিনায় হিজরতের পরও ১৬ থেকে ১৭ মাস পর্যন্ত মুসলমানদের কিবলা ছিল মসজিদুল আকসা। পরবর্তীতে রাসুল (সা.)-এর আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ বাইতুল্লাহকে কিবলা নির্ধারণ করেন। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুল (সা.) মক্কায় থাকাকালীন কাবাকে সামনে রেখে জেরুজালেমের দিকে ফিরে সালাত আদায় করতেন। মদিনায় হিজরতের পরও ১৬ মাস পর্যন্ত এভাবে সালাত আদায় করেছেন। এরপর কিবলা কাবার দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। (সহিহ বুখারি-৪০)।

কোরআন-স্বীকৃত পবিত্র ভূমি : মসজিদুল আকসা এবং আশপাশের এলাকাকে পবিত্র কোরআনে পবিত্র ভূমি আখ্যা দেয়া হয়েছে। এটাও মসজিদুল আকসার অনন্য বৈশিষ্ট্যের একটি। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, হে আমার সম্প্রদায়, পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করো, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং তোমরা তোমাদের পেছন দিকে ফিরে যেও না। অন্যথায় তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। (সুরা মায়েদা : ২১)।

মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চারদিকে আমি বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখিয়ে দেই। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। (সুরা ইসরা : ০১)।

মেরাজের সূচনাস্থল : ইসরা ও মেরাজের সফর রাসুলের (সা.) জীবনের বিস্ময়কর ঘটনা ও আল্লাহর নিদর্শন। বায়তুল্লাহ থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণকে ইসরা এবং মসজিদুল আকসা থেকে ঊর্ধ্বাকাশের ভ্রমণকে বলা হয় মেরাজ। সেই হিসেবে রাসুল (সা.)-এর মেরাজের সূচনা হয়েছিল মসজিদুল আকসা থেকে। এ কারণে বলা যায়, মসজিদুল আকসা রাসুল (সা.)-এর মেরাজের সূচনাস্থল। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চারদিকে আমি বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখিয়ে দিই। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা (সুরা ইসরা : ০১)।

মেরাজের ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার জন্য বোরাক আনা হলো। বোরাক হলো গাধা থেকে বড় এবং খচ্চর থেকে ছোট একটি সাদা রঙের প্রাণী। দৃষ্টির শেষ সীমায় তার পদক্ষেপ পড়ে।’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি এতে আরোহণ করলাম এবং বাইতুল মাকদিসে (মসজিদুল আকসা) পৌঁছলাম। অতঃপর নবীগণ তাদের বাহনগুলো যে খুঁটির সাথে বাঁধতেন, আমি সে খুঁটির সাথে আমার বাহনটি বাঁধলাম। তারপর মসজিদে প্রবেশ করলাম এবং দুই রাকাআত সালাত আদায় করে বের হলাম’ (সহিহ মুসলিম-১৬২)।

নবী-রাসুলদের স্মৃতির স্মারক : মহান আল্লাহ মসজিদুল আকসা ও তার আশপাশে যত নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন, অন্য কোনো অঞ্চলে এত নবী-রাসুল পাঠাননি। অনেক নবী-রাসুল এমন ছিলেন, যারা ভিন্ন অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছেন, পরবর্তীতে আল্লাহর আদেশে এই মসজিদের জনপদে হিজরত করেছেন। সেই হিসেবে এই অঞ্চলটিকে নবী-রাসুলদের স্মৃতির স্মারক বলা যায়। শুধু তাই নয়, মসজিদুল আকসার আশপাশে নবী-রাসুলদের যত কবর আছে, অন্য কোনো অঞ্চলে এত কবর পাওয়া যায় না। ইবরাহীম ও লুত (আ.)-এর হিজরতের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং আমি তাকে (ইবরাহীম) ও লুতকে উদ্ধার করে এমন এক ভূমিতে নিয়ে গেলাম, যেখানে আমি সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য বরকত রেখেছি’ (সুরা আম্বিয়া : ৭১)।

মসজিদুল আকসা পৃথিবীর দ্বিতীয় মসজিদ : আমরা জানি, এই পৃথিবীতে নির্মিত প্রথম ঘর বায়তুল্লাহ, যা মক্কায় অবস্থিত। এটি একদিকে যেমন পৃথিবীর প্রথম ঘর অন্যদিকে এটা পৃথিবীর প্রথম মসজিদ। এরপর যে মসজিদটি নির্মিত হয় তা হলো মসজিদুল আকসা। অর্থাৎ, মসজিদুল আকসা পৃথিবীর দ্বিতীয় মসজিদ। এটাও মসজিদুল আকসার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের অন্যতম। এ বিষয়ক একটি হাদিস দেখুন। আবু যর গিফারী (রা.) হতে বর্ণিত, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন মাসজিদ তৈরি করা হয়েছে? তিনি বললেন, ‘মাসজিদুল হারাম।’ বললাম, অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘মসজিদুল আকসা’। বললাম, উভয় মসজিদের মাঝে কত সময়ের ব্যবধান ছিল? তিনি বললেন, ৪০ বছর। (সহিহ বুখারি-৩৩৬৬; সহিহ মুসলিম-৫২০)

মসজিদুল আকসার উদ্দেশে ভ্রমণ ইবাদত : এই পৃথিবীতে তিনটি মসজিদ ব্যতীত যত মসজিদ আছে, ইসলামের চোখে সবই সমান। সেই তিনটি মসজিদ হলো বায়তুল্লাহ, মসজিদে নববী এবং মসজিদুল আকসা। এই তিনটি মসজিদের পর পৃথিবীতে আর কোনো মসজিদের একটির ওপর অপরটির ফজিলত নেই। এমনকি কোনো মসজিদকে গুরুত্বপূর্ণ ভেবে সোয়াবের নিয়তে ভ্রমণ করাও জায়েজ নেই। তবে হ্যাঁ, উল্লিখিত তিনটি মসজিদকে বরকতময় ভেবে সে উদ্দেশে ভ্রমণ করা সোয়াবের কাজ। এটাও মসজিদুল আকসার একটি বৈশিষ্ট্য। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মসজিদুল হারাম, মসজিদুর রাসুল এবং মসজিদুল আকসা এই তিনটি মাসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো মসজিদে (সালাতের) উদ্দেশে হাওদা বাঁধা যাবে না’ (অর্থাৎ সফর করা যাবে না)। (সহিহ বুখারি-১১৮৯; সহিহ মুসলিম-১৩৯৭)

এক রাকাতে ২৫০ রাকাতের সওয়াব : মসজিদুল আকসা এতটাই বরকতপূর্ণ এবং ফজিলতময় স্থান, সেখানে কেউ এক রাকাত নামাজ পড়লে ২৫০ রাকাত নামাজের সোয়াব পাওয়া যায়। একটি হাদিস দেখুন। আবু যর রা. থেকে বর্ণিত, আমরা তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আলোচনা করেছিলাম, আমরা তার কাছে জানতে চাইলাম, কোনটি উত্তম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদ নাকি বায়তুল মাকদিসের মসজিদ? তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমার এই মসজিদে একটি নামাজ সেখানকার চারটি নামাজের চেয়ে উত্তম। (মুসতাদরাক হাকিম-৮৬০০; তালখিসুল মুসতাদরাক : ৪/৫০৯; হাকিম ও যাহাবীর মতে সহীহ)। এই হাদিসের আলোকে আমরা জানতে পারলাম, মসজিদুল আকসার নামাজের তুলনায় মসজিদে নববীর নামাজ চারগুণ বেশি উত্তম। আর আমরা জানি, মসজিদে নববীর দুই রাকাত নামাজ ১ হাজার রাকাতের সমান। আর ১ হাজারের এক-চতুর্থাংশ হলো ২৫০। অর্থাৎ, মসজিদুল আকসার দুই রাকাত নামাজ ২৫০ রাকাত নামাজের সমতুল্য।

গুনাহ মাফের স্থান : মসজিদুল আকসার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি গুনাহ মাফের জায়গা। কেউ যদি নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদুল আকসায় গমন করে, তবে আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেন। মসজিদুল আকসা নির্মাণকাজ শেষ করার পর সুলাইমান আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি এই মসজিদে সালাত আদায়ের জন্য আসবে, সে যেন গুনাহ থেকে সেদিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়, যেদিন তার মা তাকে জন্ম দিয়েছিল’। আর নবী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, মহান আল্লাহ তার নবী সুলাইমান (আ.)-এর এই দোয়া কবুল করবেন। (মুসনাদে আহমদ : হা ৬৬৪৪; শায়খ শু‘আইব আরনাঊত : সহিহ)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত