ওয়াকফ অধ্যাদেশ ১৯৬২-এর ২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো মুসলমানের ধর্মীয়, পবিত্র বা দাতব্য কাজের উদ্দেশ্যে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি স্থায়ীভাবে উৎসর্গ করাকে ওয়াকফ বোঝায়। তবে কোনো অমুসলিম ব্যক্তি ওয়াকফের উদ্দেশ্যে তার সম্পত্তি দিতে পারবেন।’ ওয়াকফের স্বতন্ত্র আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। যা কোরআন-সুন্নাহ স্বীকৃত এবং দলিল-প্রমাণ থেকে গৃহীত। ওয়াকফ ব্যবস্থা যুগের সঙ্গে উৎকর্ষও হয়েছে। বিভিন্ন দেশে এর আইনি অবকাঠামো প্রস্তুত করা হয়েছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফিকহ ফোরাম ও শরিয়া বোর্ড তাদের সিদ্ধান্ত ও শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড প্রকাশ করেছে।
ওয়াকফ একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এর কল্যাণ ও উৎপাদন বেনিফিসিয়ারিদের প্রাপ্য। পাশাপাশি এটি একটি সদকায়ে জারিয়া। রাসুল (সা.) নিজে ওয়াকফ করেছেন। উম্মতকে করতে উৎসাহিত করেছেন। সাহাবিরাও ব্যাপকভাবে এ আমলটি করেছেন। এটি যেমনিভাবে ওয়াকিফ (দাতা)-এর জন্য স্থায়ী পুণ্য লাভের কারণ, তেমনি টেকসই সমাজ বিনির্মাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানুষের মৃত্যুর পর সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের সওয়াব চলমান থাকেÑ সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম এবং নেক সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম : ১৬৩১)। তাই ওয়াকফ হলো উভয় জগতে পরিব্যপ্ত কল্যাণকর একটি ব্যবস্থা। সুতরাং এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শরিয়া সবিস্তারে নীতিমালা ও বিধান দিয়েছে। যা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব মোতাওয়াল্লি ও প্রশাসনের। কিন্তু বর্তমান সময়ে এ বিষয়ে ব্যাপক অবহেলা ও উদাসীনতা দেখা যায়।
মোতাওয়াল্লি কাকে বলে?
ওয়াকফ প্রপার্টি একটি লিগ্যাল পার্সন বা আইনগত স্বত্বা। যার পক্ষে পরিচালক থাকতে হয়। যাকে পরিভাষায় মোতায়াল্লি বা নাজিরুল ওয়াকফ বলা হয়। মোতা?য়াল্লি দাতা কর্তৃক নিযুক্ত হতে পারে বা প্রশাসন ও আদালত কর্তৃকও হতে পারে। তিনি মূলত প্রপার্টির পক্ষে প্রতিনিধি হয়ে কাজ করেন। (মাসউলিয়্যাতুল ওয়াকফ : ৫০)। ওয়াকফ অধ্যাদেশ ১৯৬২-তে বলা হয়েছে, মোতাওয়াল্লি হলো, ওয়াকফ করার সময় বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লিখিত, মৌখিক বা অন্য কোনো উপায়ে ওয়াকফ পরিচালনার জন্য নির্ধারিত ব্যক্তি। মোতাওয়াল্লির প্রতিনিধি বা মোতাওয়াল্লির কার্য পরিচালনার জন্য অন্য কোনো নিযুক্ত ব্যক্তি। অপারগ বা অসুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী মোতাওয়াল্লির ওসি বা অন্য কোনো ব্যক্তি বা কমিটি, যারা ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নিযুক্ত থাকে।
মোতাওয়াল্লির যোগ্যতা
১. শরিয়ার আলোকে মোতাওয়াল্লির প্রধানত দুটি চরিত্র এক. প্রতিনিধি, দুই. কর্তৃত্বকারী। এ দুটি চরিত্রের জন্য প্রতিবন্ধক কোনো দোষ থাকতে পারবে না। যেমনÑ শরিয়ার দৃষ্টিতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক, নির্বোধ, পাগল বা বিকারগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি। (শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড ২৩, ধারা : ৩/২)।
২. মোতাওয়াল্লি আমানতদার ও বিশ^স্ত হওয়া আবশ্যক। সুতরাং কোনো প্রমাণিত খেয়ানতকারী ব্যক্তি মোতাওয়াল্লি হওয়ার উপযুক্ত নয়। (রদ্দুল মুহতার : ৩/৩৮৫)।
৩. মোতাওয়াল্লি নিজের কাজ নিজে সম্পাদন করতে বা তার কোনো প্রতিনিধি দ্বারা হলেও কাজ করাতে সক্ষম হতে হবে। (প্রাগুক্ত)।
৪. মুসলিম হওয়া। অমুসলিম ব্যক্তি মোতাওয়াল্লি হওয়ার উপযুক্ত নয়। (সুরা নিসা : ১৪১)।
মোতাওয়াল্লির মধ্যে উপরিউক্ত মৌলিক ৪টি যোগ্যতা থাকা জরুরি। কারণ ওয়াকফ প্রপার্টির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, তা যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং তা থেকে উৎপাদন করে বেনিফিসিয়ারিদের মাঝে বিতরণ করা; আর ওয়াকফকারীর সদকায়ে জারিয়া প্রাপ্তির উদ্দেশ্য সফল করা। সুতরাং একজন মোতাওয়াল্লি আমানতদার বিচক্ষণ দায়িত্ববোধ সম্পন্ন সুবুদ্ধির অধিকারী ও মুসলিম হওয়া ছাড়া উক্ত উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হওয়ার আশা করা যায় না।
মোতাওয়াল্লির দায়িত্ব
১. প্রপার্টি সংরক্ষণ ও যতœ করা। ২. মেরামত, সংস্কার ও উন্নয়ন করা। ৩. ইজারা দেওয়ার মাধ্যমে তার উপযোগ বৃদ্ধি করা। ৪. চাষাবাদযোগ্য জমিতে ফসল ফলানো। ৫. ওয়াকফের সম্পদ থেকে উৎপন্ন উপযোগ বেনিফিসিয়াদের মাঝে শরিয়া-সম্মতভাবে বিতরণ করা। ৬. অডিট ও হিসাব সংরক্ষণ করা। ৭. ওয়াকফনামার শর্তাবলি যথাযথ বাস্তবায়ন করা। তবে শরিয়াবিরোধী কোনো শর্ত থাকলে বা ওয়াকফ প্রপার্টি অথবা বেনিফিসিয়াদের অধিকার খর্ব হয়, এমন কোনো শর্ত থাকলে তা বাস্তবায়ন করা যাবে না। (ফিকহ বিশ্বকোষ, কুয়েত : ৪৪/৩১ ও ১০৯)।
প্রশাসনের দায়িত্ব
অন্যান্য অনেক মুসলিম দেশের মতো বাংলাদেশেও ওয়াকফ প্রশাসন ও আইন রয়েছে। ১৯১৩ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের দানকে কথিত বৈধতা প্রদানের নামে বাজেয়াপ্ত করার জন্য ‘ওয়াকফ বৈধকরণ আইন’ পাস করা হয়। পরবর্তীকালে ‘বেঙ্গল ওয়াকফ অ্যাক্ট ১৯৩৪’ দ্বারা ওয়াকফ ভূসম্পত্তির ব্যবস্থাপনা কাঠামোর ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটানো হয়। ১৯৬২ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান ওয়াকফ অধ্যাদেশ ১৯৬২’-এর অধীনে ওয়াকফ সম্পত্তিগুলো পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত আইনের সংশোধন করা হয়। ১৯৮৮ সালে ওয়াকফ অধ্যাদেশ সংশোধন করা হয়। তখন থেকে একটি স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ হিসেবে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়কে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়।
উক্ত প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য হলো, ওয়াক?ফ করা সম্পত্তি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামাজিক ও ধর্মীয় কল্যাণ সাধন এবং এ সম্পত্তির সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের মাধ্যমে অর্জিত আয় দ্বারা ইসলামি বিধানাবলির আলোকে সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা। শরিয়ার আলোকেও উক্ত দায়িত্ব পালন করা ওয়াকফ প্রশাসকের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমনÑ অ্যাওফি শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড ৩৩, ধারা ৫/৫-এ বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের উক্ত দায়িত্ব পরিপালনের চিত্র নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন থেকে গেছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ করানো, ওয়াকফ কার্যালয়ের বহুতল ভবন নির্মাণ করা, আর বিশেষ কিছু দিবস পরিপালন করার বাইরে উক্ত প্রশাসনের কোনো কার্যক্রম সম্পর্কে বার্ষিক অডিটেও কিছু উল্লেখ নেই। (বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৮-১৯)। অপরদিকে ২০১৭ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা দেশে বর্তমানে ওয়াকফ এস্টেটের আওতায় তালিকাভুক্ত জমির পরিমাণ ৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৭১.৭৪ একর। কিন্তু ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন ওয়াকফ এস্টেটের ৯০ শতাংশ ভূমিই এখন অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসনের তালিকায় স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে দেশে সাড়ে ৩ লাখ ওয়াকফ এস্টেটের মধ্যে ৩ লাখ ২৯ হাজারই বেদখল হয়ে গেছে।
ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষায় দেশীয় আইন থাকার পরেও এ বেহাল অবস্থার জন্য দায়ী অব্যবস্থাপনা, সদিচ্ছার অভাব, মোতাওয়াল্লি বা কমিটির অযোগ্যতা এবং প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা। শরিয়ার দৃষ্টিতে মোতাওয়াল্লির আবশ্যকীয় কোনো গুণাবলির বিবেচনা বা জবাবদিহিতার সংস্কৃতি নেই। তা ছাড়া ওয়াকফ আইনের অনেক বিষয়ই শরিয়া দৃষ্টিকোণ থেকে সংশোধনযোগ্য। উদাহরণস্বরূপÑ ওয়াকফ আইন ১৯৬২-এর কোনো কোনো ধারা ও বিধিমালায় সুদের উপস্থিতিকে মেনে নেওয়া হয়েছে। যেমন ধারা ৭২ বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসন বিধি, ১৯৭৫-এর বিধি ৮-এর ৯ ক ও খ, ১২ ক, ১৩, ১৮ গ, ১৯ গ ও ঘ ইত্যাদি। (ত্রৈমাসিক ইসলামি আইন ও বিচার পত্রিকা : বর্ষ ১২, সংখ্যা ৪৭, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৬)।
শরিয়া সুপাইভাইজরি বোর্ড
ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, শরিয়া সুপারভাইজরি বোর্ড। যার সদস্যরা ওয়াকফ ও তার পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত শরিয়া বিষয়ে অভিজ্ঞ হবে। যারা ওয়াকফের বিনিয়োগসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক দিক সম্পর্কেও পারদর্শী হবেন। (নাহওয়া মুরাকিব শরঈ ওয়াকফি : ৩)। কিন্তু আমাদের দেশের ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। মসজিদভিত্তিক ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি ইতিবাচক দিক হলো, প্রত্যেক মসজিদে যোগ্য ইমাম ও খতিব রয়েছেন। যাদের থেকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ও আয়-ব্যয়ে শরিয়া পরামর্শের সেবা নেওয়া সম্ভব। কিন্তু সেটিও দুঃখজনভাবে বাস্তবায়িত হয় না।
মসজিদ ও মোতাওয়াল্লি বা কমিটি
সাধারণ ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের চেয়ে মসজিদের ওয়াকফ আলাদা ও অত্যন্ত স্পর্শকাতর। পরকালে এর জবাবদিহিতা অন্যগুলোর চেয়ে অধিক ও কঠিন। পরিচালনায় থাকার জন্য অন্যান্য ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এখানে থাকতে হয় স্বতন্ত্র গুণাবলি। ঈমানের পরিপক্বতা, পরকালের বিশ্বাস, নামাজ আদায়ে গুরুত্ব ও যতœশীলতা, দান-সদকায় অগ্রসরতা এখানে বিশেষভাবে বিবেচ্য। (সুরা তওবা : ১৮)। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় সব মসজিদের অভিন্ন চিত্র হলো, পরিচালনায় থাকা কমিটি বা মোতাওয়াল্লির কেউই এসব তোয়াক্কা করছেন না। আয়-ব্যয়সহ মসজিদের পবিত্রতা ও ওয়াকফের বিধিবিধান রক্ষায় তাদের অনিয়ম ও অবহেলা অযাচিত ও গর্হিত। ইমাম ও খতিবদের কাছ থেকে শরিয়া আইন ও অডিটবিষয়ক সেবা নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ইমাম-খতিবদেরকেই উল্টো পরিচালনা করা হয়ে থাকে। বিভিন্নভাবে শরিয়া বিষয়ে তাদের স্বাধীন মতামত প্রদানের সুযোগ সঙ্কুচিত করে রাখা হয়।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা
ইমাম ও খতিব, বাইতুস সালাম জামে মসজিদ, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা