আল্লাহতায়ালা বান্দাদের অফুরন্ত নেয়ামতের মাঝে ডুবিয়ে রেখেছেন। তাঁর একটি অনন্য নেয়ামত হলো, হক চেনা ও হক বোঝার জন্য তিনি সুসংহত ব্যবস্থা রেখেছেন। স্থাপন করেছেন হকের সুউচ্চ মিনার। উপস্থাপন করেছেন অকাট্য দলিল-প্রমাণ। আল্লাহ যাদের তৌফিক দেন, তারা এসবের মাধ্যমে সঠিক পথ পেয়ে যায়। যারা সৃষ্টিজগতে দৃষ্টি প্রসারিত করে, সত্য উপলব্ধির চেষ্টা করে, গভীর মনোযোগের সঙ্গে কোরআন অধ্যয়ন করে, তারা নিশ্চিতভাবে জেনে নেয় যে, আল্লাহতায়ালা মানুষকে সুস্থ প্রকৃতির ওপর সৃষ্টি করেছেন, তাদের সৃষ্টিজগতের নানা নিদর্শনের দিকে পথপ্রদর্শন করেছেন এবং শক্তিশালী প্রমাণাদিসহ অসংখ্য নবী-রাসুল তাদের কাছে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহতায়ালা তাঁর সন্তুষ্টি-প্রত্যাশী বান্দাদের জন্য পথ সহজ করে দিয়েছেন। ফলে তারা তাঁর দাসত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। এরই পাশাপাশি তিনি বিভ্রান্ত হৃদয়গুলোকে তার অবাধ্যতা থেকে সতর্কও করেছেন।
ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য
ইবাদত হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য, দ্বীন কায়েম করতে হবে- এটা সব নবী-রাসুলের প্রতি আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। আল্লাহতায়ালা এ ব্যাপারে নুহ, ইবরাহিম, ঈসা, মুসা ও শেষ নবী মুহাম্মদ (তাদের সবার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক) কে উপদেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য একটি দ্বীন প্রণয়ন করেছেন, যে ব্যাপারে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন নুহকে এবং যা আমি অহি পাঠিয়েছি তোমার কাছে এবং যে ব্যাপারে নিদের্শ দিয়েছি ইবরাহিম, মুসা ও ঈসাকে। তা হলো- তোমরা দ্বীন কায়েম কর ও দ্বীনের ব্যাপারে বিভক্ত হয়ো না।’ (সুরা শুরা : ১৩)। এ প্রসঙ্গে কোরআনে অনেক আয়াত বারবার গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে। প্রত্যেক নবীর দাওয়াত এই একই মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক জাতির কাছে রাসুল পাঠিয়েছি, আর তাদের বলেছি- তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর ও তাগুতকে (আল্লাহ ছাড়া যা কিছুর ইবাদত করা হয়) বর্জন করো।’ (সুরা নাহল : ৩৬)।
তাওহিদের গুরুত্ব
কোরআন-সুন্নাহর বহু স্থানে তাওহিদের গুরুত্বের কথা ও তা সব আমলের ভিত্তি হওয়ার কথা আলোচিত হয়েছে। তাওহিদহীন কোনো আমল গ্রহণযোগ্য নয়। শয়তান সব সময় বনী আদমকে ধোঁকা দিতে তৎপর থাকে। সে তাদের তাওহিদ ও ইখলাস থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। ইবলিস এ ব্যাপারে শপথও করেছে। আল্লাহতায়ালা বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, ‘সে বলে, আপনার সম্মানের শপথ! আমি তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করব। তবে আপনার ইখলাসওয়ালা বান্দারা ছাড়া।’ (সুরা সোয়াদ : ৮২-৮৩)। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি আমার সব বান্দাকেই নিষ্ঠাবানরূপে সৃষ্টি করেছি। তবে শয়তান এসে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করে ফেলে। শয়তান তাদের কাছে আমি যা হারাম করেছি, তাকে হালালরূপে উপস্থাপন করে, আর তাদের শিরকের আদেশ করে। অথচ আমি শিরকের সপক্ষে কোনো প্রমাণ নাজিল করিনি।’ (মুসলিম)।
কোরআনে আল্লাহর প্রথম আহ্বান তাঁর ইবাদত করার প্রতি। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে লোকসকল! তোমরা নিজেদের রবের ইবাদত কর, যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন; যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।’ (সুরা বাকারা : ২১)। কোরআনের সর্বপ্রথম নিষেধাজ্ঞা হলো, ‘তোমরা জেনে-শুনে কাউকে আল্লাহর সঙ্গে শরিক সাব্যস্ত কোরো না।’ (সুরা বাকারা : ২২)। ‘তোমরা নিজেদের রবের ইবাদত করো’- এ বাণীতে রয়েছে তাওহিদের নির্দেশনা। আর ‘তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না’- এ আদেশের মাঝে রয়েছে শিরকের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা। কোরআনের বহু স্থানে এভাবে তাওহিদের আদেশ ও শিরকের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক কোরো না।’ (সুরা নিসা : ৩৬)। আয়াতের প্রথমাংশে তাওহিদের আদেশ ও শেষাংশে শিরকের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। তাওহিদ অর্জন ও শিরক বর্জন পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটাই লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ। আমাদের তাওহিদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। তার শর্ত ও দাবিগুলো পূরণ করতে হবে। তাওহিদের অনুসারী পূর্বসূরিদের অনুসরণ করতে হবে। তারা যা অনুমোদন করেছেন, তা গ্রহণ করতে হবে। তারা যা নাকচ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহকে এক বলে মেনে নিতে হবে; রব হিসেবে যেমন, উপাস্য হিসেবেও। তাঁকে একক মনে করতে হবে, নাম ও গুণাবলির ক্ষেত্রে। তাঁর সঙ্গে কারও সাদৃশ্য সাব্যস্ত করা যাবে না। তাঁকে কল্পনা করার জন্য কোনো রূপের আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে না। আল্লাহর সব গুণ সদা কার্যকর। তাওহিদের অর্থে বিকৃতি সাধন গর্হিত অপরাধ।
সব সৃষ্টি মানুষের সেবায় নিয়োজিত
আল্লাহতায়ালা আসমান-জমিনের সবকিছু বান্দাদের সেবায় নিয়োজিত করে রেখেছেন। প্রভূত নেয়ামতে ভূষিত করেছেন মানবজাতিকে, মানুষ সেসব নেয়ামতের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যতে উপকৃত হয়ে থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে বিছানা বানিয়েছেন, আসমানকে ছাদ বানিয়েছেন আর আকাশ থেকে বর্ষণ করেছেন বৃষ্টি; যার সাহায্যে তোমাদের রিজিকের জন্য উৎপন্ন করেছেন নানা প্রকার ফলমূল।’ (সুরা বাকারা : ২২)। আল্লাহতায়ালা এ আয়াতে পৃথিবীর স্থিরতার কথা বর্ণনা করেছেন, বলেছেন তার ছাদের কথা। আরও উল্লেখ করেছেন পানির কথা, যা সব নেয়ামতের মূল, আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়। এরই পরে এরশাদ করেন, ‘তোমরা জেনে-শুনে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না।’ (সুরা বাকারা : ২২)। কেন তিনি নেয়ামত দিচ্ছেন, আর বান্দাদের থেকে তিনি কী চাচ্ছেন, বিয়ষগুলো অবশ্যই গভীরভাবে ভাবতে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করো না, যারা না উপকার করতে পারে, না ক্ষতি। কারণ, তোমরা তো জানো, আল্লাহ ছাড়া তোমাদের আর কোনো রব নেই, যে তোমাদের রিজিক দান করতে পারে। তোমরা এ-ও জানো যে, আল্লাহর রাসুল যার একত্ব স্বীকার করার জন্য মানুষকে আহ্বান করেন, তিনি সত্য, আর এতে কোনো সন্দেহও নেই।’ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! সবচেয়ে বড় গোনাহ কী?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘যে আল্লাহ তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করা।’ (বোখারি ও মুসলিম)। তাওহিদ সবকিছুর মূল। তাওহিদই শেষ কথা। সুবিশাল পৃথিবীর সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনাও টিকে আছে তাওহিদের কারণে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আসমান-জমিনে যদি আল্লাহ ছাড়া আর কোনো রব থাকত, তাহলে তা ধ্বংস হয়ে যেত। তারা যা বলে, আরশের অধিপতি রব সেসব থেকে পবিত্র।’ (সুরা আম্বিয়া : ২২)।
ইবাদতের প্রয়োজনীয়তা
বান্দার রিজিক ও শারীরিক সুস্থতা যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ইবাদতের তৌফিক। কারণ, এটাই মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি মানুষ ও জিনদের একমাত্র আমার ইবাদতের উদ্দেশে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা জারিয়াত : ৫৬)। বান্দার মুক্তি, সফলতা ও কল্যাণ একমাত্র তাওহিদ অর্জন, শিরক বর্জন ও দ্বীনের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠার মাঝে নিহিত। শিরক সর্বোতভাবে নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় শিরক বড় জুলুম।’ (সুরা লোকমান : ১৩)। তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শরিক করাকে ক্ষমা করবেন না। এ ছাড়া অন্যান্য গোনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করতে পারেন। যে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করল, সে ঘোরতর পথভ্রষ্ট হলো।’ (সুরা নিসা : ১১৬)। শিরক দুই প্রকার- এক. বড় শিরক। আল্লাহ এটা ক্ষমা করবেন না। তা হলো, আল্লাহ ছাড়া আর কারও যে কোনো ধরনের ইবাদত করা। দোয়া, জবাই, মানত, সেজদাসহ যেসব কাজ একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশে করা হয়, তা অন্য কারও উদ্দেশে করা। আরেকটা হলো, ছোট শিরক। কোরআন-হাদিসে যাকে শিরক বলা হয়েছে, কিন্তু তা বড় শিরকের মতো নয়। যেমন- লোক দেখানো ইবাদত, আল্লাহ ছাড়া আর কারও নামে শপথ করা ইত্যাদি। শিরক যে প্রকারই হোক, আমাদের তা পুরোপুরি পরিহার করতে হবে।
২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৪ (১৬ ডিসেম্বর ২০২২) তারিখে মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুইনুল ইসলাম