বর্তমান বিশ্ব পরিচালনার চালিকা শক্তিগুলোর মধ্যে অর্থনীতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিবছর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সামনে নিয়ে একটা বাজেট তৈরি করতে হয়। সব সময় মানুষের ধারণামাফিক অর্থনীতি গতিধারা পরিচালিত হয় না। অপ্রত্যাশিত কোনো কিছু সামনে এসে সাধন করতে পারে পরিকল্পনার আমূল পরিবর্তন। হতে পারে সেটা প্রাকৃতিক কিংবা মানব সৃষ্ট দুর্যোগ, যুদ্ধ-বিগ্রহ অথবা উৎপাদনে মন্দা। ফলত জনসাধারণ থেকে রাষ্ট্রের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অনেকে এই দূরবস্থা সামাল দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে নিঃস্ব হয়। স্বতন্ত্র অর্থ শাস্ত্র হিসেবে সারাবিশ্বে দুটি মতবাদ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অর্থাৎ মানুষের কাছে এই দুটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। একটা হলো, পুঁজিবাদ; যা সারাবিশ্বে শোষণ করে চলছে। আরেকটা হলো, সমাজতন্ত্র; যা কুক্ষিগত হয়ে আছে। সমাজতন্ত্রের আলাপ এখন বেশ লম্বা-চওড়া। স্থান ও কালভেদে দার্শনিকরা নিজেদের সুবিধার জায়গা বেছে নিয়ে নিজের মতো ব্যাখ্যা করেছে। তবে কার্ল মার্ক্সের প্রস্তাবিত মতবাদ এখন পৃথিবীতে নেই বললেই চলে। সমাজতন্ত্র প্রাধান্য পাওয়া এলাকাগুলোতে ‘নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ’রূপে যা গ্রহণ করেছে, সেটা প্রকারান্তরে পুঁজিবাদই। সমাজতন্ত্র যে মানুষের কতটা স্বভাব বহির্ভূত ছিল, তা এক শতাব্দীর আগেই তাদের মুখ থুবড়ে পতন হওয়া থেকে অনুমান করা যায়।
এরপর থেকে যায় বিশ্বের প্রচলিত অর্থব্যবস্থা পুঁজিবাদের কথা। যারা একচেটিয়া শোষণ ও নিপীড়ন করে চলছে মানুষের ওপর। তবুও কার্ল মার্ক্সের ভাষায় বলতে হয়, পুঁজিবাদ একা একা মরে না। সামন্তবাদ থেকে আমলারা নিজেদের ব্যবসা ও উৎপাদনকে রক্ষা করতে পুঁজিবাদের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। অন্যভাবে বলা যায়, এসব ব্যবসায়ীরা নিজেদের শাসকশ্রেণির কাছে নিয়ে এলিট হয়ে যায়। তাই তারা একটি ধনতান্ত্রিক-শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। ইউরোপীয় রেনেসাঁস কিংবা পুঁজিবাদী শাসনের আগে যে সামন্তবাদ পৃথিবী জোড়া শাসন করেছিল, সেটাও প্রকারান্তরে পুঁজিবাদ। তবে সুসংগঠিত নয়। সে হিসেবে ইসলামও একটা পুঁজিবাদী ধর্ম। কারণ, ধর্ম হিসেবে ইসলাম ব্যক্তি মালিকানা স্বীকার করে; কিন্তু এটাকে প্রচলিত পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে ভুল হবে। কারণ, ইসলাম একটি স্বাতন্ত্র্য অর্থব্যবস্থা।
ইসলামি অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করতে হলে বোঝার জন্য এর বিপরীতে আরেকটি অর্থব্যবস্থা রেখে আলাপ করা দরকার। সে ক্ষেত্রে পুঁজিবাদই যথোপযুক্ত। পুঁজিবাদী তথা আধুনিক অর্থব্যবস্থা চলে ঋণের ওপর। অর্থাৎ সুদের করালগ্রাসে রাষ্ট্র ও জনগণের জীবন শোষিত। সুদের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো অর্থনীতি সর্বস্তরের জনগণের জন্য ফায়দামন্দ নয়। পক্ষান্তরে ইসলামি অর্থনীতির ভিত্তি হলো মহান আল্লাহর নির্ধারিত রিজিকের ওপর। আল্লাহতায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিচালিত অর্থব্যবস্থা সর্বস্তরের জনগণের জন্য উপকারী। যেখানে পুঁজিবাদের মতো শুধু পুঁজিপতিদের কথা খেয়াল রাখা হয়নি। আবার সমাজতন্ত্রের মতো কারও ব্যক্তিগত মালিকানা অস্বীকার করা হয়নি। ধনী-গরিব সবার অধিকার সমানভাবে প্রদান করেই প্রণীত হয়েছে এ অর্থব্যবস্থা। উপরন্তু নৈতিকতার প্রশ্নেও ইসলামি অর্থব্যবস্থা সবার ঊর্ধ্বে।
ইসলামি অর্থনীতির ব্যাখ্যা-কল্পে মুফতিয়ে আজম আবদুস সালাম চাটগামী (রহ.) ‘ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূলনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। আলোচ্য গ্রন্থটি মোটাদাগে দুই অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়টিতে ইসলামি অর্থনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও উৎপত্তি নিয়ে বহুল আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়টি ব্যবসা-বাণিজ্যের মূলনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান করা হয়েছে। বইয়ের ভেতরের আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা বিষয় জানিয়ে রাখা প্রয়োজন যে, লেখক (রহ.)-এর ভাষ্যমতে এটা একটা খণ্ডনমূলক গ্রন্থ। তিনি লিখেছেন, ‘এই মূল্যবান গ্রন্থটি লেখার কারণ হলো, জনৈক ব্যক্তির এক ভাষণের সারসংক্ষেপ। তা হলো, এ পৃথিবীর মানুষ মেহনত ও কাজ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত; তাই যে ব্যক্তি বেশি মেহনত ও কাজ করবে, সে আরামের জীবনযাপন করবে। আর যে এমন করবে না, সে কষ্টে দিনাতিপাত করবে।’ এই বক্তব্যের খণ্ডন ও ইসলামি অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে তিনি গোটা একটা গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন।
বর্তমান বিশ্বের পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও বস্তুতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা ইসলামি ধ্যানধারণার গোড়ায় আঘাত করেছে। ফলত মানুষ দার্শনিক দৈন্যদশায় আকিদায় মিসকিন হয়ে গেছে। উপরন্তু মানুষের চেতনায় যখন শুধু পরিশ্রমেই ফলাফল আশা করার মন-মানসিকতা জাগরিত হয়েছে, তখন সব সম্পদের মালিক যে আল্লাহতায়ালা, সে বিশ্বাস হারিয়েছে। নৈতিকতার ন্যূনতম সীমারেখাও দম্ভের সঙ্গে অতিক্রম করেছে। এসব বিভিন্ন বাতিল, নষ্ট, বিকৃত ও মিথ্যা ধ্যান-ধারণার শেকড়ে কুঠারাঘাত করে লেখক বইটি শুরু করেছেন ‘ইসলামি অর্থব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য’ পরিচ্ছেদ দিয়ে। যাতে চেতনা জগতে ইসলামি আলোর সঞ্চার হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে মানুষের মনুষ্যত্বের মূলতত্ত্ব, সৃষ্টিকর্তার মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য, মাখলুকের ওপর খালেকের দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। মহান রাব্বুল আলামিনের বড়ত্ব ও বিশালতা বর্ণনা করার পর লেখক তার রিজিক বণ্টন ও অধিকার সম্পর্কে দালিলিক পর্যালোচনা করেছেন। প্রথম অধ্যায়ের শেষের দিকে রিজিক অন্বেষণের তাগিদ ও উপার্জনের শরঈ মূলনীতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
এ হিসেবে প্রথম অধ্যায়টি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম ভাগে মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য, দ্বিতীয় ভাগে মহান রবের সক্ষমতা ও দায়িত্ব, তৃতীয় ভাগে মানুষের অধিকার ও রিজিকের বণ্টন ব্যবস্থা, চতুর্থ ভাগে হালার রিজিকের অন্বেষণের তাগিদ এবং পঞ্চম ভাগে ইসলামি অর্থনীতির নৈতিকতার আলোচনা করা হয়েছে। মোদ্দাকথা, জাহেলি অর্থব্যবস্থায় নিমজ্জিত মুসলিম জাতিকে পর্যায়ক্রমে বেরিয়ে আসার জন্য যা প্রয়োজন, তা বহুলাংশেই তিনি প্রথম অধ্যায়ে এনেছেন। এরপর ‘একনজরে ব্যবসা-বাণিজ্যের মূলনীতি’ শীর্ষক দ্বিতীয় অধ্যায়টি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এটা স্বতন্ত্রভাবে ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণীত হয়েছে। এখানে ব্যবসার শরঈ মূলনীতি সম্পর্কে বেশ কিছু আলোচনা করা হয়েছে। যেমন- শেয়ার বাজার, সুদ, প্রতারণা, অন্যের মাল হস্তগত না হওয়ার আগেই বিক্রি ইত্যাদি নানা ধরনের প্রচলিত সমস্যা সম্পর্কে আলাপ করেছেন। তবে এখানে এর থেকেও বড় দার্শনিক অবস্থানটা হলো, ইসলাম যে ব্যবসায় উৎসাহিত করে, তার বহিঃপ্রকাশ। যা আসলে ব্যক্তিগতভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার কথাই নির্দেশ করে। আলোচিত গ্রন্থটির মূল বার্তাটি হলো, ইসলাম ধর্মটি পরকালের চিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত। অন্যভাবে বলা যায়, এটা বস্তুবাদ ও ভাববাদের যথাযথ সন্নিবেশ হয়ে প্রণীত। এ জন্য ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা হিসেবে এর স্বতন্ত্র অর্থব্যবস্থা রয়েছে। পরজাগতিক ধ্যান-ধারণার কারণে নৈতিকতার প্রশ্নে অন্যান্য অর্থব্যবস্থা থেকে বহু ঊর্ধ্বে। এর কারণ হলো, অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ অর্থাৎ চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, লুটতরাজ, চাঁদাবাজি, সুদ, ঘুষ, অন্যের অধিকার ও সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখলে তা ব্যক্তির জন্য বৈধ হয়ে যায় না। এর থেকে উপার্জিত সব সম্পদ অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এমনকি বিচারক তার সম্পদ তলব করা ছাড়াও সে গোনাহগার হবে। এর হিসেব মহান আল্লাহর কাছে দিতে বাধ্য।
পরজাগতিক ধ্যান-ধারণার কারণে ইসলামি অর্থব্যবস্থা অন্যান্য বাতিল অর্থব্যবস্থা থেকে শ্রেষ্ঠ। কেননা, এ অর্থব্যবস্থাজুড়ে নৈতিকতার প্রশ্ন সব সময় লেগে আছে। পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্রে যার বালাই নেই। বইটির নাম অনুযায়ী যা আলোচনা করা হয়েছে, তার ওপর সমালোচনার জায়গা খুব একটা নেই। এটা ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূলনীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তাই ইসলামি অর্থব্যবস্থা কীভাবে আসতে পারে, সেটা নেই। পুঁজিবাদী সুদব্যবস্থা হটিয়ে ইসলামি অর্থব্যবস্থা কীভাবে কায়েম করা যায়, এ ব্যাপারে আলোচনা থাকলে আরও ভালো হতো। এটা অবশ্য রাষ্ট্রীয় আলাপ। অপরদিকে বইটি ব্যক্তি পর্যায়ে বাস্তবায়ন করার মতো। সুতরাং বলা যায়, বইটি আপন জায়গায় সুমহান অবস্থানেই আছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে বইটিকে উপজীব্য করে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ইসলামি অর্থনীতির ওপর অভিসন্দর্ভ রচিত হবে, ইনশাআল্লাহ। ইত্তিহাদ পাবলিকেশন প্রকাশিত বইটি ঘরে বসে ০১৮৪৩ ৯৮৪ ৯৮৪ নম্বরে ফোন করে সংগ্রহ করা যাবে।