টেকসই উন্নয়নের জন্য মহাসাগর, সমুদ্র এবং সামুদ্রিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সমস্যা হলো মহাসাগরীয় অর্থনীতি। যা কখনও কখনও ‘সুনীল অর্থনীতি’ বা ব্লু ইকোনোমি নামে পরিচিত। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি এসডিজি-১৪, টেকসই উন্নয়নের জন্য মহাসাগর, সমুদ্র এবং সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত। মানব জীবনের প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং শক্তি সমুদ্র সম্পদ দ্বারা সরবরাহ করা হয়। ভূপৃষ্ঠের তিন-চতুর্থাংশ উপেক্ষা করলে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে। ফলস্বরূপ এসডিজি-১৪ উন্নয়ন ও লক্ষ্য অর্জনে সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদ টেকসইভাবে ব্যবহার করার নিশ্চয়তা দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ।
বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বাংলাদেশের উপকূলরেখা ৭১০ কিলোমিটারেরও বেশি বিস্তৃত। দেশের মোট মাছ উৎপাদনের ১৯.৪০ শতাংশ সামুদ্রিক মাছ উৎপাদন করে। উপরন্তু কক্সবাজারে গড়ে বাংলাদেশে আসা বিদেশি দর্শনার্থীদের ৮১ শতাংশ। বাংলাদেশের সমুদ্র সারাদেশে, বিশেষ করে দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে এর আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। বাংলাদেশ নতুন অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে বঙ্গোপসাগরকে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে তার বিশাল সামুদ্রিক সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য ব্লু ইকোনোমি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার ব্লু ইকোনোমির ওপর অনেক কর্মশালার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সাতটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা একটি শক্তিশালী ব্লু ইকোনোমি বজায় রাখতে মাছ, নবায়নযোগ্য শক্তি, মানবসম্পদ, পরিবহন, পর্যটন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ১২টি উদ্যোগকে চিহ্নিত করে। উপরন্তু ব্লু ইকোনমি সেল ২০১৭ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্বারা সেক্টরাল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ব্লু ইকোনমি প্রকল্পগুলোর সমন্বয় সাধনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মালবাহী পরিমাণের ৯০ শতাংশ সমুদ্রবাহী। তাই ভবিষ্যতে আমাদের অর্থনীতিতে মালবাহী বাণিজ্য একটি বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সারা দেশে উচ্চ স্তরের মালবাহী চার্জ বজায় রাখতে আঞ্চলিক শিপিং সংস্থাগুলোকে তাদের বহর সম্প্রসারণের জন্য প্রণোদনা প্রদান করা যেতে পারে। আমাদের দেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অভিজ্ঞতা অব্যাহত রাখতে হলে উপকূলীয় শিপিং, সমুদ্রবন্দর, যাত্রী ফেরি পরিষেবা, অভ্যন্তরীণ জলপথ পরিবহন, জাহাজ নির্মাণ এবং জাহাজ পুনর্ব্যবহারসহ সামুদ্রিক শিল্পগুলোতে আরও মনোযোগ দেয়া উচিত।
সমুদ্র থেকে শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া, হাঙর, অক্টোপাস এবং অন্যান্য প্রজাতি ছাড়াও ৫০০টি বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যায়। বঙ্গোপসাগরে যে ৮.০ মিলিয়ন টন মাছ পাওয়া যায়, তার মধ্যে বাংলাদেশে বছরে মাত্র ০.৭০ মিলিয়ন টন মাছ ধরা হয়। বিশ্বব্যাপী মানুষের চাহিদার প্রোটিনের ১৫.০ শতাংশের উৎসই আসে সামুদ্রিক সম্পদ থেকে। এ ছাড়া অনেক মানুষ তাদের খাদ্য এবং জীবনযাত্রার জন্য মহাসাগরের ওপর নির্ভর করে। তাই সমুদ্রের সম্পদ রক্ষার জন্য আরও অনেক কিছু করতে হবে।
সমুদ্র থেকে আসতে পারে পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাস জোগান। বাংলাদেশ এখনও তার অফশোর গ্যাস সম্ভাবনার পূর্ণ সম্ভাবনার মূল্যায়ন করতে পারেনি। বাংলাদেশের সমুদ্রের অংশেও গ্যাসের মজুদ থাকতে পারে। বাংলাদেশের স্থলভাগে কিছু গ্যাস সম্পদ রয়েছে এবং মিয়ানমারের মতো বাংলাদেশের সমুদ্রে আরও গ্যাসক্ষেত্র লাভের সম্ভাবনা থাকতে পারে, যা দেশের মোট গ্যাস রিজার্ভে যোগ করা যেতে পারে। উপরন্তু সমুদ্রসম্পদ হিসেবে তেল এবং গ্যাস, সমুদ্রের লবণ, নীল শক্তি (অস্মোসিস), জৈববস্তু, সমষ্টি খনন (বালি, নুড়ি ইত্যাদি) এবং সামুদ্রিক জেনেটিক সম্পদের প্রতি আরও মনোযোগ দেওয়া জরুরি। অতএব, সম্ভাবনার এ প্রাচুর্য আমাদের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বে সহায়ক হতে পারে।
ব্লু ইকোনোমির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অংশ হচ্ছে পর্যটন। সমুদ্র উপকূলীয় পর্যটন বিশ্বব্যাপী জিডিপির ৫.০ শতাংশ এবং সবধরনের কর্মসংস্থানের ৬.০ থেকে ৭.০ শতাংশ তৈরি করে। এটি ১৫০টি দেশের শীর্ষ পাঁচটি রপ্তানি উপার্জনকারীর মধ্যে রয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের অর্ধেকের জন্য এটি তাদের বৈদেশিক মুদ্রার (এলডিসি) প্রাথমিক উৎস হিসেবে কাজ করে। সমুদ্র সৈকতভিত্তিক বিনোদন এবং পর্যটন, সমুদ্র উপকূলীয় পর্যটন, ইয়টিং এবং মেরিনস উপকূলীয় পর্যটনের অন্যতম উদাহরণ। টেকসই পর্যটনের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস এবং নতুন চাকরির সম্ভাবনা তৈরি করা যেতে পারে। আমাদের দেশে ৭৫টি দ্বীপ রয়েছে, যা স্থানীয় এবং বিদেশি উভয় পর্যটকদের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। ফলে পর্যটন খাতে বিদেশি নগদ অর্থ উপার্জন বাড়াবে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং এসডিজি অর্জনে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত সম্প্রসারিত হতে পারে, যদি এ সামুদ্রিক সম্পদগুলোকে সঠিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অন্বেষণ ও কাজে লাগানো যায়। ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে দীর্ঘ মতবিরোধের পর বাংলাদেশের এখন বঙ্গোপসাগরে একটি পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত সামুদ্রিক অঞ্চল রয়েছে। সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষা এবং সামুদ্রিক সম্পদের শোষণের মধ্যে একটি সুস্থ ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার ব্লু ইকোনোমি বিকাশে এবং তার বিশাল সমুদ্র অঞ্চলের সর্বাধিক ব্যবহারে মনোযোগ দিতে পারে। এখন যেহেতু সামুদ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন বিনিয়োগ করা হয়েছে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিশ্চয়তা দিতে তার সক্ষমতা বাড়াতে পারে। জাতি মাত্র ব্লু ইকোনোমি খাতগুলোর একটি ছোটসংখ্যক খতিয়ে দেখা শুরু করেছে, যেমন মাছ ও জলজ পালন, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ ভাঙা, লবণ উৎপাদন এবং বন্দর অবকাঠামো। উপরন্তু এ সেক্টরগুলোর বেশিরভাগই ঐতিহ্যগত পদ্ধতি ব্যবহার করে। পরিবেশগত পরিবর্তনগুলো পরিচালনা ও কার্বন নিঃসরণ পরিচালনা করতে, ম্যানগ্রোভ ও সাগর ঘাস সংরক্ষণ করতে এবং আরও উন্নয়নের জন্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তি প্রবর্তন করতে ব্লু ইকোনোমি এখনও অনেক সম্ভাব্য সমস্যা অন্বেষণ করা বাকি।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইএমবিএ, মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা