আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তাঁর কাছে প্রতিদান প্রাপ্তির একমাত্র মাধ্যম নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, জিকির ও দোয়াই নয়; বরং এগুলোর পাশাপাশি জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমেও একজন মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও উত্তম প্রতিদান পেতে পারে; নেকির পাল্লা ভারী করতে পারে। এসব কাজ শ্রমসাধ্য না হলেও আল্লাহর দরবারে মূল্যবান ও ভারী আমল হিসেবেই বিবেচিত। এ জন্যই মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও সদকার চেয়ে মর্যাদাবান আমলের সংবাদ দেব?’ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘মানুষের মাঝে সমঝোতা করে দেয়া। কেননা, মানুষের মধ্যকার বিশৃঙ্খলা ধ্বংসাত্মক।’ (মুসনাদে আহমদ : ৭৫০৮)। ইসলামে সমাজসেবার ধারণা এত বিস্তৃত যে, তা যে কোনো শ্রেণির মানুষের পক্ষে করা সম্ভব। ইসলাম সমাজসেবাকে কোনো স্থান বা সময়ের সঙ্গে আবদ্ধ করেনি। তাকে আর্থিক সেবায় সীমাবদ্ধ করেনি। শারীরিক শ্রমে সীমিত করেনি। বুদ্ধিভিত্তিক পরিষেবায় সংকুচিত করেনি। বরং ইসলামে সমাজসেবার ধারণা একটি বিস্তৃত প্রাঙ্গণের মতো; যেখানে সব মানুষ তার সামর্থ্যানুযায়ী অবদান রাখতে পারবে। ধনী-গরিব, শক্তিশালী-দুর্বল, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার অংশ রয়েছে তাতে। ইসলাম সমাজসেবা, কল্যাণমূলক কাজকে মানবিকতা ও মহানুভবতার ওপর ছেড়ে দেয়নি; বরং ইসলামের দৃষ্টিতে মানবসেবা মানুষের মানবিক, সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব।
সম্পদের বণ্টনব্যবস্থা আল্লাহর বিশেষ উদ্দেশ্যে হয়
আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে ধনী ও গরিব দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। কিছু মানুষকে বিশেষ দয়ায় বহু নেয়ামত দিয়েছেন; আর কিছু মানুষকে বিশেষ হেকমতের কারণে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করেছেন; যারা স্বভাবতই ধনীর সম্পদের মুখাপেক্ষী। ধনী ও গরিবের এ ব্যবধান কারও প্রতি জুলুম নয়। আল্লাহতায়ালা ইচ্ছে করলে সবাইকে সমান করতে পারতেন; কিন্তু তা করেননি। কারণ, এ ব্যবধান পৃথিবীর ভারসাম্যের জন্য অপরিহার্য। নিজের যোগ্যতা আর বুদ্ধির বলে আসলে কেউ সম্পদশালী হতে পারে না। বুদ্ধি আর যোগ্যতাই যদি সম্পদশালী হওয়ার মাপকাঠি হতো, তাহলে সব বুদ্ধিমানই সম্পদশালী হয়ে যেত। বাস্তবে দেখা যায়, অনেক বুদ্ধিমান শিক্ষিত মানুষ অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্র হয়ে আছে। আবার অনেক অশিক্ষিত, হাবাগোবা ধরনের মানুষ বহু সম্পদের অধিকারী। সম্পদের এ বণ্টনব্যবস্থা মূলত আল্লাহ কর্তৃক বিশেষ উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। আল্লাহতায়ালা মূলত মানুষকে পরীক্ষা করার জন্যই ধনী-গরিবের এ ব্যবধান সৃষ্টি করেছেন। ধনী তার ধন পেয়ে মহান আল্লাহকে ভুলে যায় কি-না? আর গরিব তার অভাবের কারণে নাফরমানিতে লিপ্ত হয় কি-না? এ পরীক্ষা করাই হলো ধনী-গরিবের ব্যবধানের মূল কারণ।
সমাজের বিত্তবানের করণীয়
সমাজের বিত্তবানের করণীয় হলো, গরিব-দুঃখী, ফকির-মিসকিন ও অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা তাদের খাবারের প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও সে খাবার অসহায়, এতিম এবং বন্দিদের খাওয়ায়।’ (সুরা দাহর : ৮)। অভুক্ত ব্যক্তিকে আহার্য দেয়ার ফজিলত প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানুষের কল্যাণ-সংশ্লিষ্ট যত কাজ আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম হচ্ছে, দরিদ্র ও ক্ষুধার্তকে খাবার দান করা।’ (বোখারি : ১২)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘প্রতিদিন মানুষের শরীরের প্রতিটি জোড়ার বিপরীতে সদকা করা আবশ্যক। দুই ব্যক্তির মধ্যে ন্যায়বিচার করা একটি সদকা; নিজের বাহনে কাউকে বহন করা বা তার পণ্য বহন করা একটি সদকা, ভালো কথা একটি সদকা, নামাজের উদ্দেশে চলা প্রতিটি পদক্ষেপ একটি সদকা, রাস্তা থেকে কষ্টকর বস্তু সরিয়ে ফেলা একটি সদকা।’ (সুনানে বায়হাকি : ৩০৫৭)। একইভাবে হাদিসে এসেছে, মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা, বধির ব্যক্তিকে কিছু বুঝিয়ে দেয়া, অন্ধকে পথ দেখিয়ে দেয়া, সুপরামর্শ দেয়া, দুর্বল ব্যক্তির বোঝা বহন করে দেয়া ইত্যাদি কাজ আল্লাহর কাছে মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত এবং উত্তম দান। এভাবেই ইসলাম সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। পারস্পারিক সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া এবং সামাজিক পতন রোধ করার দীক্ষা দিয়েছে। ইসলামি সমাজে মৌলিক অধিকারে সবাই সমান।
বিপদাপদে একে অপরের পাশে থাকা
রাসুল (সা.) কেয়ামতের একটি চমৎকার দৃশ্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। যেখানে মহান স্রষ্টা তাঁর বান্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন। এরশাদ হচ্ছে, নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন বলবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম, তুমি আমার সেবা করনি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার রব! আমি আপনার সেবা কীভাবে করব? আপনি তো জগতসমূহের প্রতিপালক।’ আল্লাহতায়ালা বলবেন, ‘তুমি কি জানতে না, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল? তুমি তার সেবা কেন করনি? তুমি কি জানতে না, তার সেবা করলে তুমি তার কাছে আমাকে পেতে।’ এরপর আল্লাহতায়ালা বলবেন, ‘আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, তুমি আমাকে আহার করাওনি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার রব! আপনি তো জগতগুলোর প্রতিপালক, আপনাকে আমি কিভাবে খাবার খাওয়াব?’ আল্লাহতায়ালা বলবেন, ‘আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, তুমি তাকে খাবার দাওনি। তুমি কি জানতে না, যদি তুমি তাকে খাওয়াতে, তবে তা আমার কাছে এসে পেতে।’ এরপর আল্লাহতায়ালা বলবেন, ‘আমি তোমার কাছে পানি পান করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক, আপনি তো জগতগুলোর প্রতিপালক। আমি কীভাবে আপনাকে পান করাব?’ আল্লাহতায়ালা বলবেন, ‘আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি পান করতে চেয়েছিল? তুমি তাকে পানি পান করাওনি। যদি তুমি তাকে পানি পান করাতে, তবে তুমি তা আমার কাছে এসে পেতে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৪২৬০)। অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে চলার সময় একটি কাঁটাযুক্ত ডাল দেখল এবং তা রাস্তা থেকে সরিয়ে দিল। আল্লাহতায়ালা তার কাজে সন্তুষ্টি হলেন এবং তাকে মাফ করে দিলেন।’ (মুসলিম : ২৫৬৯)।