খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। এগুলোর যোগান দিতে মানুষকে বেছে নিতে হয় সম্পদ উপার্জনের নানাবিধ পন্থা। জীবিকা-নির্বাহের জন্য মানুষ যেসব পেশা অবলম্বন করে, তা হলো- কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, শিল্প ইত্যাদি। উপার্জনের মাধ্যম ছাড়া কোনো ব্যক্তির পক্ষে উপর্যুক্ত মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। তাই কর্মের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কারও পক্ষে এক বোঝা জ্বালানি সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নিয়ে আসা কারও কাছে কিছু চাওয়ার চেয়ে উত্তম। অনেক সময় চাইলে সে দিতেও পারে, আবার নাও দিতে পারে।’ (বোখারি : ২০৭৪)।
নবী-রাসুল নিজ হাতে কর্ম সম্পাদন করতেন
নবী-রাসুলদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা নিজ হাতে কর্ম সম্পাদনকে অধিক পছন্দ করতেন। আমাদের প্রিয়নবী (সা.)-এর জীবনে প্রাথমিক সময়ে ছাগল চড়ানো ও পরবর্তী সময়ে খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসায়িক দায়িত্ব পালনের বর্ণনা পাওয়া যায়; যা নিজ হাতে জীবিকা নির্বাহে উৎকৃষ্ট প্রমাণ বহন করে। এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিজ হাতের শ্রমে উপার্জিত জীবিকার চেয়ে উত্তম আহার কেউ কখনও গ্রহণ করেনি। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।’ (বোখারি : ২০৭২)।
ফরজ ইবাদতের পর হালাল উপার্জনও ফরজ
মহান আল্লাহ তাঁর নির্ধারিত ফরজ ইবাদত (নামাজ) সম্পন্ন করার পর জীবিকা অন্বেষণে জমিনে ছড়িয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর। আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো; যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা জুমা : ১০)। কিন্তু উপার্জনের এ পন্থা অবলম্বন করতে গিয়ে আজকাল বহু লোক চড়া মূল্যের লোভে খাদ্য ইত্যাদি মজুত রাখা, কালোবাজারি ও ধোঁকাবাজি করাসহ অবৈধ ও অনৈতিক বহু পন্থা বেছে নিচ্ছে; যা মুসলমান হিসেবে খুবই দুঃখজনক। যার ফলে যেমন তারা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি অন্য সবাইকে ঠকাচ্ছে। অথচ ইসলামের রীতি-নীতি এর বিপরীত।
চড়া মূল্যের লোভে খাদ্য মজুত রাখার পরিস্থিতি
অধিক লাভের আশায় পণ্য মজুত রাখা বর্তমান বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলোতে কোনো অপরাধ নয়। অথচ এর ফলে পণ্যের মূল্য হুট করে বেড়ে যায়, জনসাধারণের দুঃখ কষ্টের সীমা থাকে না; কিন্তু একচেটিয়া কারবারের উদ্দেশ্যেই এ মজুতদারি। দেখা যায়, একশ্রেণির ব্যবসায়ী মৌসুমের শুরুতেই ধান-চাল, পেঁয়াজ-রসুন, সব রকমের ডালসহ নানা শস্য বিপুল পরিমাণে গুদামজাত করে রাখে। ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়। দাম বেড়ে যায় দ্রুত। এ সুযোগে বিপুল অর্থ উপার্জন করে মজুতদার। একইভাবে শিল্পজাত পণ্যের ও মজুতদারি চলে। সাবান, টুথপেস্ট, শিশুখাদ্য, সার, সুতা, চিনি, ভোজ্য তেল, কাগজ, টিন ইত্যাদি এমন কোনো বস্তু নেই, ব্যবসায়ীরা যা মজুত করে না। তার পরিমাণ এত বেশি যে, বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখা দেবেই। সৃষ্টি হবে এক দুঃসহ অস্বাভাবিক অবস্থা। সাধারণ মানুষ তখন এদের দয়ার পাত্র হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পেছনে একটি বড় কারণ এটিও যে, চড়া মূল্যের লোভে অসাধু ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ মজুত রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে।
অধিক মূল্যের লোভে খাদ্য মজুত রাখা নিষেধ
রাসুল (সা.) চড়া মূল্যের লোভে জিনিসপত্র, খাদ্য ইত্যাদি গুদামজাত করে রাখতে নিষেধ করে বলেন, ‘যে চড়া মূল্যের লোভে খাদ্য ইত্যাদি মজুত করে রাখে, সে অপরাধী।’ (মুসলিম : ১৬০৫)। রাসুল (সা.) পণ্য মজুত কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে বলেন, ‘যে বেক্তি ইহতিকার করবে অর্থাৎ অতিরিক্ত দামের আশায় চল্লিশ দিন যাবত খাদ্যদ্রব্য বিক্রি না করে আটকে রাখবে, আল্লাহর সঙ্গে তার ও তার সঙ্গে আল্লাহর সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৪৮৮০)। অপর হদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমদানিকারী (পণ্য সরবরাহকারী) ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় এবং মজুতদার অভিশপ্ত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৫৩)। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের বিরুদ্ধে (বা সমাজে) খাদ্যদ্রব্য মজুতদারি করে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্র্যতার কষাঘাতে শাস্তি দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৫৫)। মানুষের খাদ্য, কাপড়-চোপড় ও আসবাবপত্রসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস গুদামজাত করে রাখার পরিণাম বিবেকবানদের কাছে অস্পষ্ট নয়; যা গুটি কয়েক স্বার্থান্বেষী ছাড়া ব্যাপকহারে কল-কারখানা, মিল-ফ্যাক্টরি, ব্যবসায়ী, কর্মজীবি, পেশাজীবি ও দিনমজুরসহ সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটা স্পষ্ট জুলুম। এ কাজ থেকে যেমন মুনাফাখোরী মানসিকতার সৃষ্টি হয়, তেমনি ব্যবসায়িক অসাধুতা হতেই নৈতিকতাবিরোধী মনোবৃত্তি গড়ে ওঠে। এ জন্য দেশে দেশে কালোবাজারি ও চোরাকারবারি সংঘটিত হচ্ছে। দেশপ্রেম বা জনগণের স্বার্থ এদের কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। যেভাবেই হোক না কেন, অধিক হতে অধিকতর মুনাফা অর্জনই এদের একমাত্র লক্ষ্য। নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে তারা বৈষয়িক উন্নতির পথ বেছে নেয়।
কালোবাজারি ও ধোঁকাবাজি ইসলামে নেই
এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, চোরাকারবার যেমনভাবে দেশের অর্থনৈতিক ধ্বংস ডেকে আনে, কালোবাজারিও তেমনি সামাজিক অবক্ষয়ের গতি ত্বরান্বিত করে। এরই প্রতিবিধানের জন্য রাসুল (সা.) মদিনায় হিজর নামে একটি দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যার কাজ ছিল ব্যবসায় অসাধুতা নিয়ন্ত্রণ করা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের দোকানপাট বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের পরিচালনায় নিয়ে আসা। খোলাফায়ে রাশেদিন (রা.) পর্যন্ত এ ব্যবস্থা বহাল ছিল। পারস্পরিক লেনদেনে ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার ব্যাপারে রাসুল (সা.) কঠিন হুঁশিয়ারি বাক্য উচ্চারণ করে বলেন, ‘যে আমাদের ধোঁকা দেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (মুসলিম : ১০১)। বস্তুত সততা ও আমানতদারিতাই হলো ইসলামি অর্থনীতি ও লেনদেনের মূলধন; যার পথ ধরে নির্মিত হয় মানবতা। আর অজ্ঞরা মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আশ্রয় নেয় প্রতারণার। নানা রকম ধোঁকাবাজি করে বেড়ায়। অবৈধভাবে হাতিয়ে নেয় মানুষের ঘামঝরা অর্থ-সম্পদ। তাদের এ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে রাসুল (সা.)-এর বর্ণনা আপোষহীন। ইসলাম সঠিক ও ন্যায়সঙ্গতভাবে কাজের প্রতি উৎসাহ দেয়। ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, সুদি কারবারি করে অপর ভাইয়ের অর্থ-সম্পত্তি গ্রাস করাকে বৈধতা দেয় না। কারণ, ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানুষের ক্ষতি না করে বরং প্রয়োজনে তার পাশে দাঁড়ানো ইসলামের শিক্ষা। বিশ্বমানবতার মহানবী (সা.) বলেন, ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলু?ম করবে না এবং তাকে জালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে কেউ (দুনিয়ায়) তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহতায়ালা (কেয়ামতের দিন) তার প্রয়োজন পূরণ করবেন। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের বিপদ দূর করবে, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তার বিপদগুলো দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন।’ (বোখারি : ২৪৪২)।
লেখক : মুহাদ্দিস ও বিভাগীয় প্রধান : আরবি ভাষা ও সাহিত্য, মদিনাতুল উলুম মাহমুদিয়া, নারায়ণগঞ্জ