মহানবী (সা.) অত্যন্ত দুনিয়াবিমুখ ছিলেন। দুনিয়াবিমুখতার গুণ তার মাঝে পূর্ণাঙ্গ মাত্রায় ছিল। পার্থিব উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির চিন্তা কখনও তিনি করতেন না। পরকালের চিন্তায় সব সময় ব্যস্ত থাকতেন। পরকাল কীভাবে সজীব, জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করা যায়, পরকালীন জীবনকে কীভাবে সুখণ্ডশান্তিময় করা যায়, সে চিন্তায় ব্যস্ত থাকতেন। কেনই বা বিশ্বনবী (সা.) দুনিয়াবিমুখ থাকবেন না? রাব্বুল আলামিন তাকে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও সৌন্দর্যের উপকরণের দিকে দৃষ্টিপাত করতে নিষেধ করে বলেছেন, ‘আমি এদের বিভিন্ন ধরনের লোককে পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জীবনের সৌন্দর্যস্বরূপ ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, আপনি সেসব বস্তুর প্রতি দৃষ্টি দেবেন না। আপনার পালনকর্তার দেয়া রিজিক উৎকৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী।’ (সুরা তহা : ১৩১)। মহানবী (সা.) আল্লাহতায়ালার উল্লিখিত নির্দেশ পূর্ণাঙ্গভাবে মেনে চলতেন। পার্থিব সহায়-সম্পত্তির প্রতি তার কোনো মোহ ছিল না। দুনিয়ার চাকচিক্য তাকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হতো না। ধনৈশ্বর্য, বিত্ত-বিভব ও স্বর্ণ-রুপা সঞ্চয় করার চিন্তা তার মাঝে ক্রিয়াশীল ছিল না। আবু যর (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম, তিনি ওহুদ পাহাড় দেখে বললেন, ‘পাহাড়টি আমার জন্য স্বর্ণে পরিণত করা হোক এবং এর মধ্য হতে একটি স্বর্ণ মুদ্রাও আমার কাছে তিন দিনের বেশি থাকুক, তা আমি কামনা করি না। তবে সেই স্বর্ণমুদ্রা ছাড়া, যা আমি ঋণ আদায়ের জন্য রেখে দিই।’ তারপর তিনি বললেন, ‘অধিক সম্পদশালীই কম সওয়াবের অধিকারী হয়; কিন্তু যারা এভাবে-ওভাবে ব্যয় করেন, তারা ছাড়া।’ (বর্ণনাকারী) আবু শিহাব তার সামনের দিকে এবং ডান-বাম দিকে ইশারা করে বোঝান, এরূপ লোক খুব কম আছে।’ (বোখারি : ২৩৮৮)।
দরজায় নকশা করা পর্দা ঝুলতে দেখেন
ফাতেমা (রা.) ছিলেন মহানবী (সা.)-এর সর্বকনিষ্ঠ মেয়ে। তিনি মহানবী (সা.)-এর কলিজার টুকরো ছিলেন। বিশ্বনবী (সা.) তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন ও খুব ভালোবাসতেন। অন্যান্য সন্তানের চেয়ে তার প্রতি মহানবী (সা.)-এর স্নেহ ও ভালোবাসা একটু বেশিই দেখা যেত। একদিন তার আদরের দুলালিকে দেখার জন্য বিশ্বনবী (সা.) আলী (রা.)-এর বাড়ি গেলেন। কিন্তু ফাতেমা (রা.)-এর ঘরে নকশাবিশিষ্ট একটি পর্দা ঝুলন্ত ছিল। তিনি আদুরে মেয়ের সঙ্গে দেখা না করেই চলে এলেন। আলী (রা.) আবার তার বাড়ি যাওয়ার জন্য নিবেদন করলেন। মহানবী (সা.) বললেন, ‘পার্থিব ভোগ-বিলাসের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) একবার ফাতেমা (রা.)-এর ঘরে গেলেন। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করলেন না। আলী (রা.) ঘরে এলে ফাতেমা (রা.) তাকে ঘটনা জানালেন। তিনি আবার নবীজি (সা.)-এর কাছে বিষয়টি নিবেদন করলেন। তখন তিনি বললেন, ‘আমি তার দরজায় নকশা করা পর্দা ঝুলতে দেখেছি। দুনিয়ার চাকচিক্যের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?’ আলী (রা.) ফাতেমা (রা.)-এর কাছে এসে ঘটনা খুলে বললেন। ফাতেমা (রা.) বললেন, ‘তিনি আমাকে এ সম্পর্কে যা ইচ্ছে নির্দেশ দিতে পারেন।’ তখন নবীজি (সা.) বললেন, ‘অমুক পরিবারের অমুকের কাছে এটা পাঠিয়ে দাও; তাদের প্রয়োজন আছে।’ (বোখারি : ২৬১৩)।
এক নাগাড়ে তিন রাত পেট পুরে খাননি
বিশ্বনবী (সা.) ইচ্ছে করলে কোরমা-পোলাও খেয়ে জীবন পার করতে পারতেন; স্বর্ণের পাহাড়ের মালিক হতে পারতেন। আল্লাহতায়ালার কাছে পার্থিব যে কোনো সুযোগ-সুবিধা কামনা করলে আল্লাহতায়ালা অবশ্যই তাকে দিতেন। কিন্তু ভোগ-বিলাসের লালসা তার একদম ছিল না। মাসের পর মাস তার ঘরের চুলায় আগুন জ্বলত না। কিন্তু তারপরও এদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। সামান্য পানি ও খেজুর খেয়ে মাসের পর মাস চলে যেত। এতে তার ও তার পরিবার-পরিজনের কোনো দুঃখবোধ ছিল না। আয়েশা (রা.) একবার উরওয়া (রহ.)-এর উদ্দেশে বললেন, ‘ভাগ্নে! আমরা নতুন চাঁদ দেখতাম, আবার নতুন চাঁদ দেখতাম। এভাবে দু’মাসে তিনটি নতুন চাঁদ দেখতাম। কিন্তু রাসুল (সা.)-এর কোনো ঘরেই আগুন জ্বালানো হতো না!’ উরওয়া (রহ.) বলেন, ‘আমি জিজ্ঞেস করলাম, খালাম্মা! আপনারা তাহলে বেঁচে থাকতেন কীভাবে?’ তিনি বললেন, ‘দু’টি কালো জিনিস, অর্থাৎ খেজুর আর পানিই শুধু আমাদের বাঁচিয়ে রাখত। কয়েক ঘর আনসার রাসুল (সা.)-এর প্রতিবেশী ছিল। তাদের কিছু দুগ্ধবতী উট ও বকরি ছিল। তারা রাসুল (সা.)-এর জন্য দুধ হাদিয়া পাঠাত। তিনি আমাদের তা পান করতে দিতেন।’ (বোখারি : ২৫৬৭)। গমের রুটি স্বল্প ব্যয়ের এক সাধারণ আহার্য। এমন আহার্য জোগাড় করতে খুব বেশি টাকাণ্ডপয়সার প্রয়োজন হয় না; কিন্তু তারপরও রাসুল (সা.)-এর পরিবার-পরিজন একাধারে তিন রাত পর্যন্ত এ সামান্য আহার্যও পেট পুরে খাননি। আয়েশা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) মদিনায় আসার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার পরিবারের লোকেরা এক নাগাড়ে তিন রাত গমের রুটি পেট পুরে খাননি।’ (বোখারি : ৫৪১৬)।
দানের পথে অভাবের ভয় প্রতিবন্ধক হতো না
আজকের পৃথিবীর লোকরা চিন্তা করে মৃত্যুর সময় পরিবার-পরিজনের জন্য কী সম্পদ রেখে যাবে? কিছু লোক পরিবার-পরিজনের চিন্তায় হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে ডান-বাম হতে সম্পদ উপার্জন করতে থাকে। মানুষের হক নষ্ট করে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়তে থাকে। কিন্তু মহানবী (সা.) পরিবার-পরিজনের জন্য কিছু রেখে যাওয়ার চিন্তা করতেন না। বিশ্বনবী (সা.) যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন তার পরিবার-পরিজনের জন্য তেমন কিছুই রেখে যাননি। তার কাছে যখন যে সম্পদ আসত, তা অকাতরে আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিতেন। দরিদ্র ও অসহায় লোকদের দান করতে তিনি কোনো ধরনের কুণ্ঠাবোধ করতেন না। তার দানের পথে অভাবের ভয় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াত না। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আনসার সম্প্রদায়ের কিছু লোক রাসুল (সা.)-এর কাছে কিছু সাহায্য চাইল। তিনি তাদের দান করলেন। তারা আবারও চাইল। তিনি আবারও দিলেন। এমনকি তার কাছে যে সম্পদ ছিল, তাও ফুরিয়ে গেল। এরপর তিনি বললেন, ‘আমার কাছে যখন কোনো মালামাল থাকে, তা তোমাদের দিতে কোনো কুণ্ঠাবোধ করি না। আর যে ব্যক্তি অন্যের কাছে চাওয়া থেকে বেঁচে থাকতে চায়, আল্লাহতায়ালা তাকে পরের কাছে হাত পাতার অভিশাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। আর যে ব্যক্তি স্বনির্ভর হতে চায়, আল্লাহতায়ালা তাকে বেপরোয়া ও স্বনির্ভর করে দেন। আর যে ব্যক্তি ধৈর্যের পথে অগ্রসর হয়, আল্লাহ তাকে ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দান করেন। আল্লাহর দেওয়া অবদানগুলোর মধ্যে ধৈর্য শক্তির চেয়ে উত্তম অবদান আর কিছু নেই।’ (মুসলিম : ২৩১৪)।
সঞ্চয়ের মনোবাঞ্ছনা লালন করতেন না
বিশ্বনবী (সা.) যখন পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন, তখন তার ঘরে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘মহানবী (সা.) যখন ইন্তেকাল করলেন, তখন যৎসামান্য যব ছাড়া কোনো প্রাণি খেতে পারে, এমন কিছু আমার খাবারের তাকে ছিল। তা থেকে বেশ কিছুদিন খেলাম। এরপর একবার মেপে নিলাম, তখন তা শেষ হয়ে গেল।’ (বোখারি : ৬৪৫১)। মহানবী (সা.)-এর মাঝে অল্পেতুষ্টি ছিল। টাকাণ্ডপয়সা সঞ্চয় করার মনোবাঞ্ছনা একদম লালন করতেন না। চাইলে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে অধিক সম্পদশালী হতে পারতেন। হতে পারতেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বাধিক ধনকুবের। কিন্তু তিনি সে পথে অগ্রসর হননি। রাসুল (সা.) মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, আল্লাহতায়ালা যেন তাকে শুধু তার পরিবার-পরিজনের পানাহার পরিমাণ সম্পদ দান করেন। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে; রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে আল্লাহ?! মুহাম্মদের পরিবার-পরিজনের পানাহারের প্রয়োজন পরিমাণ রাখুন।’ (মুসলিম : ২৩১৭)।
বিশ্বনবী (সা.) অত্যন্ত সাধারণ মানের পোশাক-পরিচ্ছদ পরতেন। বাহারি পোশাকের ধার ধারতেন না। অধিকাংশ সময় স্বল্পমূল্যের মোটা কাপড় পরতেন। আবু বুরদা (রা.) বলেন, আয়েশা (রা.) আমাদের সামনে একটি লুঙ্গি ও একটি তালিবিশিষ্ট চাদর বের করে বললেন, ‘এর ভেতরই রাসুল (সা.) মৃত্যুবরণ করেন।’ ইবনে হাতেম (রহ.) তার বর্ণিত হাদিসে মোটা লুঙ্গির কথা বলেছেন। (মুসলিম : ৫৩৩৬)। অন্যদিকে বহু সাহাবি মহানবী (সা.)-কে সাধারণ মানের চাদর পরতে দেখেছেন। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে চলছিলাম। এ সময় তার পরনে চওড়া পাড়ওয়ালা একটি নাজরানি ডোরাদার চাদর ছিল। একজন বেদুঈন তার কাছে এলো। সে তার চাদর ধরে খুব জোরে টান দিল। এমনকি দেখতে পেলাম, রাসুল (সা.)-এর কাঁধে চাদরের পাড়ের দাগ পড়ে গেছে। তারপর সে বলল, ‘হে মুহাম্মদ! আপনার কাছে আল্লাহর যে সম্পদ আছে, তা থেকে আমাকে কিছু দিতে বলুন।’ রাসুল (সা.) তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এরপর তাকে কিছু দান করার নির্দেশ দিলেন। (বোখারি : ৫৮০৯)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ,
চকবাজার, ঢাকা