মুফতি মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
সাবেক সহকারী মুফতি, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম খাদেমুল ইসলাম (গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা), টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ
প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
প্রশ্ন : বর্তমানে ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী ও বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য ওয়ারেন্টি ও গ্যারান্টিরসহ বিক্রি করা হয়। এভাবে ওয়ারেন্টি বা গ্যারান্টির শর্তে বিক্রি করা জায়েজ হবে?
উত্তর : ওয়ারেন্টি ও গ্যারান্টির শর্তে বেচাকেনা করা এবং এর দ্বারা উপকৃত হওয়া জায়েজ। এটি পণ্য কেনাবেচার জন্য একটি সহায়ক শর্ত। (আদ্দুররুল মুখতার : ৫/৮৬, তাবয়িনুল হাকায়েক : ৪/৩৮৯, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৩৮০, তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিম : ১/৬৩৫, ফতোয়ায়ে খানিয়া : ১/২১৮, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/২০৯)।
প্রশ্ন : বর্তমানে অঘোষিতভাবে চোরাই মার্কেট নামে বিভিন্ন মার্কেট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেসব মার্কেটে জুতা, মোবাইল ইত্যাদি পণ্য কেনাবেচা করা হয়। জানা সত্ত্বেও ওইসব জুতাণ্ডমোবাইল কেনা বৈধ হবে কী?
উত্তর : বিক্রেতা মোবাইলটি চুরি করে এনেছে, এ কথা জানা থাকলে তা কেনা যাবে না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জেনেশুনে চুরিকৃত বস্তু কিনল, সে চুরির অপরাধে শরীক হলো।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ১১/৩৩৭)। বিখ্যাত তাবেয়ি ইবনে সিরিন (রহ.) আবিদা আস সালমানি (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘চুরিকৃত বস্তু জানা থাকা সত্ত্বেও আমি কি তা কিনতে পারব?’ তিনি বললেন, ‘না।’ (শরহুল মাজাল্লা : ১/২৬২, ফতোয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া : ২৯/৩২১, ইতরে হেদায়া : ৬০)।
প্রশ্ন : কালোবাজারিরা বাস, ট্রেন ও লঞ্চের টিকিট কম দামে কিনে রেখে বেশি দামে বিক্রি করে। যাত্রীরাও নিরুপায় হয়ে ৪০০ টাকার টিকেট ৫০০ টাকায় কিনে নেয়। এভাবে বাস বা ট্রেনের টিকিট কিনে রেখে পরবর্তী সময়ে বেশি দামে বিক্রি করা জায়েজ হবে?
উত্তর : টিকিট কিনে এভাবে ব্যবসা করা জায়েজ নয়। কেননা, একটি টিকিট কেনার অর্থ হলো, একটি সিট ভাড়া নেয়া। আর এভাবে সিট ভাড়া নিয়ে বেশি ভাড়ায় অন্যের কাছে হস্তান্তর করা নাজায়েজ। (আল মাবসুত লিস সারাখসি : ১৫/১৩০, আলমুহিতুল বোরহানি : ১১/২৬৮)।
প্রশ্ন : লটারির কাগজ, তাস, লুডু, আতশবাজী ইত্যাদি বিক্রি করার হুকুম কী?
উত্তর : উল্লিখিত বস্তুগুলো বিক্রি করা জায়েজ নয়। (সুরা লোকমান : ৬, রদ্দুল মুহতার : ৯/৫০২)।
প্রশ্ন : হিন্দুদের পূজা উপলক্ষ্যে বসা মেলায় বেচাকেনা করার যাবে? এসব মেলায় যত ধরনের দোকান বসানো হবে, প্রায় সব দোকান মুসলমানদের। এ উপলক্ষ্যে মুসলমানদের ব্যবসা করা, লেনদেন করা, ক্রয়কৃত পণ্য ব্যবহার করা বা খাদ্যদ্রব্য খাওয়া যাবে কী?
উত্তর : যদি অমুসলিমদের মেলায় এমন বস্তু কেনাবেচা করা হয়, যা মূলত হালাল, যেমন- বাচ্চাদের ছবিহীন খেলনা, হালাল খাবার ইত্যাদি, তাহলে উক্ত লেনদেন ও বেচাকেনাকে হারাম ও নাজায়েজ বলার সুযোগ নেই। কিন্তু যেহেতু এভাবে দোকান দেয়ার মাধ্যমে অমুসলিমদের শান ও শওকত বাড়ে, তাই এসব স্থানে বেচাকেনা ও ব্যবসা করা থেকে বিরত থাকা উচিত। (কিতাবুন নাওয়াজেল : ১৬/৩৫১)।
প্রশ্ন : কেউ যদি কোনো পণ্য সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়, তবে লোকেরা তাকে দিয়ে সেই পণ্যটি কেনায়। কখনও বিদেশ থেকেও কিনে আনার প্রস্তাব দেয়। এমন পণ্য বাজারে সাধারণত যে দরে বিক্রি হয়, কেউ যদি কারও কাছ থেকে বিশেষ পরিচয় ও অভিজ্ঞতার কারণে কম দামে কিনে আনে, তাহলে কি কেনার আদেশকারীর কাছ থেকে সাধারণ বাজারদর অনুযায়ী টাকা রাখা যাবে?
উত্তর : যিনি পণ্যটি কিনতে দিয়েছেন, তার পক্ষ থেকে উক্ত ব্যক্তি ক্রয় প্রতিনিধিমাত্র। সুতরাং যে কারণেই মূল্য ছাড় পাওয়া যাক, তা মূলত ক্রেতারই প্রাপ্য। তার সম্মতি ছাড়া এই ছাড়ের টাকা ওই ব্যক্তির নেয়া বৈধ হবে না। তাই পণ্য কেনার পর যে পরিমাণ টাকা বেঁচে যাবে, তা মূল মালিককে ফেরত দিতে হবে। (মাজাল্লাতুল আহকামিল আদলিয়্যাহ : ১৪৭৯, বাদায়েউস সানায়ে : ৫/৩০, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ৩/৫৮৮, আল বাহরুর রায়েক : ৭/১৫৫)।
প্রশ্ন : কেউ যদি একটি বস্তুর দাম করে, আর বিক্রেতা তা দিতে রাজি না হয় এবং সে সেখান থেকে চলে যায়; এরপর দোকানদার তাকে ডেকে সেই দামে দিতে চায়, তবে কি সে তা নিতে বাধ্য? তাকে কি সে সেই মূল্যে গ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারবে?
উত্তর : মূল্য বলার পর বিক্রেতা যেহেতু ক্রেতার প্রস্তাবে রাজি হয়নি এবং ক্রেতা সেখান থেকে চলেও এসেছিল, তাই ওই প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেছে। সুতরাং পরে সে ওই মূল্যে পণ্য দিতে চাইলেও তা ক্রেতার জন্য নেয়া আবশ্যক নয়। এ ক্ষেত্রে বিক্রেতা ক্রেতাকে তা নিতে বাধ্য করলে অন্যায় হবে। (মাজাল্লাতুল আহকামিল আদলিয়্যাহ : ১৮৩, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ৩/৭, রদ্দুল মুহতার : ৪/৫২৭)।
প্রশ্ন : ভাড়া বাসার কোনো জিনিস অকেজো হয়ে গেলে মালিকের অনুমতি ছাড়া যদি সেই বস্তুটি লাগানো হয়, তবে ভাড়া আদায়ের সময় মালিককে এ পরিমাণ টাকা কম দেয়া যাবে কী?
উত্তর : ভাড়া ঘরবাড়ি মেরামতের প্রয়োজন হলে তা ঠিক করে দেয়ার দায়িত্ব মালিকের। ভাড়াটিয়ারা মালিকের অনুমতিক্রমে মেরামত করে নিলে তার ব্যয় মালিক থেকে নিতে পারবে। কিন্তু ভাড়াটিয়া যদি বাড়ির মালিকের অনুমতি ছাড়া নিজ থেকে তা মেরামত করে, তাহলে সে ক্ষেত্রে মালিককে ওই খরচ দেয়ার জন্য বাধ্য করতে পারবে না। উল্লেখ্য, ঘরবাড়ি বসবাস অনুপযোগী হয়ে গেলে কিংবা জরুরি মেরামতের প্রয়োজন হলে সেক্ষেত্রে মালিকের কর্তব্য হলো, তা মেরামত করে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে মেরামত না করা জুলুম। (আল মুহিতুল বোরহানি : ১১/৩৬৪, আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৭৯, খোলাসাতুল ফাতাওয়া : ৩/১৪৮, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ৪/৪৫৫, মাজাল্লাতুল আহকামিল আদলিয়্যাহ : ৫২৯)।
প্রশ্ন : আবদুল্লাহর একটি মুদি দোকান আছে। এর প্রধান ক্রেতা হলো সুদি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী। সুদি ব্যাংকের আয় ছাড়া এদের অন্য কোনো আয় আছে বলে তার জানা নেই। আর ব্যাংক থেকে যেদিন বেতন পায়, সেই টাকা দিয়েই মূলত আবদুল্লাহর বকেয়া টাকা পরিশোধ করে। এদের কাছে পণ্য বিক্রি করা তার জায়েজ হবে?
উত্তর : বিক্রেতা যদি নিশ্চিত হয় যে, সুদি ব্যাংক কর্মকর্তারা মাস শেষে ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত বেতন দিয়েই মূল্য পরিশোধ করে থাকে, তবে এমন লোকদের সঙ্গে বেচাকেনা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। শরিয়তের দৃষ্টিতে জেনে শুনে এ ধরনের টাকা মূল্য হিসেবে গ্রহণ করা জায়েজ নয়। তবে যদি এ কথা নিশ্চিতভাবে জানা না যায় যে, তারা ব্যাংকের টাকা দিয়েই মূল্য পরিশোধ করছে কিংবা তাদের আয়ের অন্য কোনো মাধ্যমও থাকে, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে অসুবিধা নেই এবং তাদের দেওয়া পণ্যমূল্য গ্রহণ করতে শরয়ি বাঁধা নেই। (শরহুল হামাবি আলাল আশবাহ : ১/৩১০, হাশিয়াতুত তাহতাবি আলাদ্দুর : ৪/১৯২, রদ্দুল মুহতার : ৬/৩৮৫, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ৫/৩৪২)। এমনিভাবে কোনো ক্রেতা সম্পর্কে যদি এ কথা সুনিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, ক্রয়মূল্য হিসেবে তিনি যে অর্থ পরিশোধ করবেন, তা হারাম পন্থায় উপার্জিত, তবে তার সঙ্গে লেনদেন করা বৈধ হবে না। (আল মুহিতুল বোরহানি : ৮/৭৩, আল বাহরুর রায়েক : ৮/২০১, খোলাসাতুল ফাতাওয়া : ৪/৩৫২, রদ্দুল মুহতার : ৫/৯৮)।