ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আলেম উদ্যোক্তাদের সোনালি অতীত

ইতিহাসের আয়নায় আলেমদের ব্যবসা-বাণিজ্য

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
ইতিহাসের আয়নায় আলেমদের ব্যবসা-বাণিজ্য

গল্পটি একজন নারী ব্যবসায়ীর। ইতিহাসের খোলা আয়নায় ফুটে উঠবে আমাদের দেড় হাজার বছরের যাপিত জীবনের স্বনির্ভরতার এক অব্যক্ত ছায়া। আত্মনির্ভরশীলতার অজানা ইতিহাস। নারী উদ্যোক্তা মাখ বিনতে হারেস (রহ.)। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও মুহাদ্দিস। প্রখ্যাত বুজুর্গ বিশিরহাফি বাগদাদি (রহ.)-এর আপন বোন। তাকওয়া ও দুনিয়াবিমুখতা এতটাই ছিল যে, খোদ বিশিরহাফি বলেন, ‘আমি তাকওয়া ও দিয়ানতদারিতা আমার এ বোন থেকেই শিখেছি। এ বোন সূতা কেটে হালাল রিজিক উপার্জন করতেন।’ ইমাম বিশিরহাফির তিন বোন ছিল। মাখ, মিদগা ও যুবদাহ। সবার বড় মাখ। এ মহীয়সী নারী তার ভাইয়ের জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর ছেলে আবদুল্লাহ বলেন, এক নারী একদিন আমার বাবার কাছে এসে বলল, ‘হে আবু আবদুল্লাহ! আমি রাতে প্রদীপের আলোতে সূতা কাঁটি। কখনও প্রদীপ নিভে গেলে চাঁদের আলোতে কাটি। এমতাবস্থায় প্রদীপে কাটা সূতা ও চাঁদের আলোতে কাটা সূতা কি আলাদা করে বিক্রি করব?’ তখন বাবা বললেন, ‘তোমার দেখার মধ্যে পার্থক্য অনুভব হলে তা বলে দেবে।’ এরপর নারীটি আরেকটি প্রশ্ন করলেন, ‘অসুস্থ ব্যক্তি প্রচণ্ড অসুস্থতায় হায় হায় করা কিংবা আহ্ধ্বনি প্রকাশ করা কি অবান্তর অভিযোগ হবে? আল্লাহর সিদ্ধান্তে ভরসা না করে অভিযোগ করার নামান্তর হবে?’ আমার বাবা বললেন, ‘আমার দৃষ্টিতে এমনটি করা অভিযোগ নয়, বরং আল্লাহর কাছে রোগীর ফরিয়াদ প্রকাশ পাচ্ছে।’ এ জবাব শুনে নারীটি চলে গেল। এরপর বাবা আমাকে বললেন, ‘এ ধরনের প্রশ্ন করতে আমি আমার জীবনে কাউকে দেখিনি। তুমি এ নারীর ঠিকানা খোঁজ করো। যা-ই হোক, আমি নারীটির পেছনে পেছনে চললাম। সে বিশিরহাফির ঘরে প্রবেশ করায় বুঝতে পারলাম, বিশিরহাফির বোন হবে হয়তো। আমার বাবাকে বিষয়টি বললে তিনি বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ। বিশিরহাফির বোন মাখ ছাড়া এ প্রশ্ন কেউ করতে পারে না।’

হৃদয় নাড়া দেয়া আরেকটি গল্প আমাদের পাশের। শায়খ আহমদ নহরওয়ালি (পাটনা, গুজরাত, ভারত)। এ মনীষী কাজি হামিদুদ্দিন ঘোরির মুরিদ ছিলেন। কাজি হামিদুদ্দিন তাকে নিয়ে গর্ব করতেন। তার সঙ্গে দেখা করার জন্য তার বাসায় নিয়মিত যেতেন। এ শায়খ আহমদ হালাল উপার্জনের জন্য কাপড় বুননের কাজ করতেন। টেক্সটাইল কারখানার পাশাপাশি নিজ ঘরেও কাপড় বুনতেন। একদিন কাজি হামিদুদ্দিন তার এ মুরিদের ঘরে সাক্ষাতের জন্য গিয়ে তাকে বললেন, ‘আহমদ! তুমি কতদিন এ কাজ করবে?’ দ্বিতীয় দিন শায়খ আহমদ কাপড় বোনার জন্য চরকি ঠিক করছিলেন। এমন সময় হাতে প্রচণ্ড চোট পেলেন। সেদিন থেকে কাপড় বুননের কাজ বাদ দিয়ে ইবাদত-সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। এক রাতে এক চোর তার ঘরে প্রবেশ করে কিছু না পেয়ে শূন্য হাতে ফিরে গেল। চোরের এ অসহায়ত্ব অনুভব করে তিনি একটি কাপড় রাস্তায় রেখে দিলেন; যেন কোনো চোর কাপড় থেকে বঞ্চিত না হয়। এ দৃশ্য দেখে চোর সকালবেলা তার সন্তানাদিসহ শায়খের খেদমতে এসে তওবা করল। শায়খের হাতে বাইয়াত হয়ে পাক্কা আবেদ বনে গেল। বাদায়ুনে এ মনীষীকে দাফন করা হয়। পাটনার নহরওয়ালা এলাকায় তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেনের ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও আমানতহীনতার এ সময়ে ইতিহাসের ছোট ছোট এ গল্পগুলো আশাজাগানিয়া। এমন অসংখ্য গল্প রয়েছে আমাদের দীর্ঘ ইতিহাসে। মোআমালাত ও মোআশারাত তথা সামাজিক শিষ্টাচার ও লেনদেনের ক্ষেত্রে আমাদের আদর্শের চরিত্রগুলো হারিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তা কারও অজানা নয়। অথচ এখনও ওলামায়ে কেরামের ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হওয়া নিজ বেরাদরিতে অচ্ছ্যুত অস্পৃশ্য হয়ে থাকার মতো। এ দায় কার? ওলামায়ে কেরাম কোরআন-হাদিসের শিক্ষা অনুযায়ী ইলমে দ্বীনের হেফাজত, আত্মনির্ভরশীলতা ও স্বাধীনভাবে দ্বীনের কাজ করার জন্য যুগে যুগে উপার্জনের বিভিন্ন মাধ্যম অবলম্বন করেছেন। দুনিয়াদারদের প্রতি অমুখাপেক্ষিতা, নিজেদের পরিবার-পরিজনের চাহিদা পূরণ করে তারা নিশ্চিন্তে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন।

ওমর (রা.) ওলামায়ে কেরামকে বলতেন, ‘হে ওলামায়ে কেরাম! দ্বীনি কাজে সংযুক্ত থেকে আল্লাহর দেওয়া রুজি তালাশ করতে থাক। পরনির্ভরশীল হয়ো না।’ আবু যিবইয়ান বলেন, ওমর (রা.) একবার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আবু যিবইয়ান! তোমার আয় কত?’ আমি বললাম, ‘আমার বেতন আড়াই হাজার।’ জবাব শুনে ওমর (রা.) বললেন, ‘চাকরির পাশাপাশি তুমি কিছু গবাদি পশুও লালন-পালন করো। হতে পারে, কোরাইশের অনভিজ্ঞ যুবক পর্যায়ের কেউ খেলাফতের দায়িত্বে এলে তোমার বেতন বন্ধ করে দিতে পারে।’

প্রসিদ্ধ তাবেঈ ইমাম আবু কিলাবা তার শিস্য আইয়ুব সাখতিয়ানিকে বলেছেন, ‘তুমি বাজারে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য কর। তাহলে মানুষের কাছে হাত পাতা লাগে না। অমুখাপেক্ষী থাকা যায়। দ্বীনদারিও ভালোভাবে আদায় হয়।’ আইয়ুব সাখতিয়ানি উস্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ট্যানারি ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যবসার লাভ দিয়ে পরিবার-পরিজনের চাহিদা পূরণ করতেন। তিনি তার ছাত্রদের বলতেন, ‘আমার পরিবার যদি একমুঠো সবজির মুখাপেক্ষী হতো, তাহলে আমি তোমাদের সামনে বসে দরস দিতাম না।’ এমন উক্তি একটি দুটি নয়, অসংখ্য। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির দায়রায় না গিয়ে সরল বাক্যে বলি, এমন হাজারো ঘটনা রয়েছে আমাদের হারানো সোনালি ইতিহাসে। এসব আত্মনির্ভরশীলতায় উন্নীত হওয়ার গল্প। হালাল, বৈধ সব পেশায় দ্বীনের আলো নিয়ে ছড়িয়ে দেওয়ার গল্প।

কথা বলছি ‘আলেম উদ্যোক্তাদের সোনালি অতীত’ বই নিয়ে। ইতিহাসের ইতিহাস সৃষ্টি করা এ গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় প্রথম। উর্দু ভাষায়ও আমাদের জানামতে প্রথম। আলোচ্য বিষয়ের গুরুত্ব ও নতুনত্ব নিয়ে বিদগ্ধ মনীষীরা যে অভিব্যক্তি পেশ করেছেন, তা সময়ের বিদ্যানদের চোখ আরও সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। কাজি আতহার মুবারকপুরি (রহ.)-এর জীবনের সেরা রচনাকর্ম হিসেবে এ গ্রন্থ হাজার বছর প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে। হাজার হাজার আলেমণ্ডওলামা, মুহাদ্দিস, ফকিহ, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, পেশাজীবি, চাকরিজীবী, ইতিহাসের ছাত্রশিক্ষক ও গবেষকসহ সবার জন্য এক অমূল্য পাথেয় এ গ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে যারা যেভাবে যুক্ত ছিলেন, সবার কর্মফলকে আল্লাহতায়ালা কবুল করুন। ওলামায়ে কেরামের ব্যবসা-বাণিজ্যের পথকে আল্লাহতায়ালা আরও সুগম করুন। এ গ্রন্থ পড়ে আলেমণ্ডওলামা ও দ্বীনদার ব্যবসায়ীসহ পাঠকের মধ্যে নতুন চেতনা জাগ্রত হবে।

ইসলামে জীবিকা অন্বেষণে ব্যবসার তাগিদ এসেছে সর্বাগ্রে। সৎ ব্যবসায়ীদের হাশর নবী-সাহাবিদের সঙ্গে হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্বয়ং আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.)। নবী, সাহাবি, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ থেকে নিয়ে হাজার বছরের ইতিহাসে সোনালি একটা অধ্যায় ছিল। যেখানে ব্যবসা ও উদ্যোক্তাদের সাফল্যের গল্প ছিল। তবে কালের পরিক্রমায় বলি কিংবা সামাজিক বিস্মৃতিতে আমরা সেই ইতিহাস হারিয়ে ফেলেছিলাম। এ বইটি আমাদের সেই হারানো ইতিহাস খুঁজে পাওয়ার একটি সূত্র তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। বইটি সম্পর্কে ভারতের প্রখ্যাত লেখক, বিদগ্ধ মনীষী মাওলানা আবদুল মাজিদ দরিয়াবাদি বলেন, ‘এ বইটি সব মানুষের চোখ খুলে দেবে।’ আশা করি, গ্রন্থটি উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী তৈরিতে দারুণ ভূমিকা রাখবে। ভারতের প্রখ্যাত লেখক, গবেষক ও ইতিহাসবিদ মাওলানা কাজি আতহার মুবারকপুরি (রহ.) রচিত উর্দু বইটির সাবলীল অনুবাদ করেছেন মাওলানা আবুল ফাতাহ কাসেমি। ২৭২ পৃষ্ঠার বইটির মুদ্রিত মূল্য ৪৮০ এবং প্রি-অর্ডার মূল্য ৩১০ টাকা। নন্দন প্রকাশনী ও কওমি উদ্যোক্তার যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত বইটি অনলাইন বুকশপ রকমারিসহ সব ই-প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যাচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত