ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইসলামে মিতব্যয়িতার তাগিদ

জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থ সঞ্চয় করে। যে অর্থ ছাড়া তার জীবন-জীবিকা নির্বাহ সম্ভব নয়। আবার কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত হালাল রিজিক ছাড়া ইবাদত-বন্দেগিও কবুল হয় না। তাই সম্পদের অপচয় না করে মিতব্যয়ী হওয়া কর্তব্য। কোরআন-হাদিসে অপব্যয় ও কার্পণ্য ছেড়ে মিতব্যয়ী হওয়ার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সেসব নিয়ে লিখেছেন দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সহ-সম্পাদক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
ইসলামে মিতব্যয়িতার তাগিদ

ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংযম বা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা কিংবা আয় বুঝে ব্যয় করার নাম মিতব্যয়িতা। ইসলাম মানুষকে অপব্যয়, অপচয় ও কৃপণতা থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। সেই সঙ্গে মিতব্যয়িতার নির্দেশও দিয়েছে অসংখ্যবার। বাড়াবাড়ি কিংবা সীমালঙ্ঘন কোনোটিই ইসলামে অনুমোদিত নয়। মিতব্যয় মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি করে এবং অন্যকে সাহায্য করার পথ খুলে দেয়। মিতব্যয়ীরা কখনোই নিঃস্ব হয় না। মিতব্যয়িতা ঈমানদারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যমপন্থার জীবন-দর্শন হচ্ছে ইসলাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যমপন্থি সম্প্রদায়ে পরিণত করেছি।’ (সুরা বাকারা : ১৪৩)। ইসলামে অপচয় ও কৃপণতা উভয়ই নিষিদ্ধ। সম্পদকে ব্যক্তি মালিকানায় কুক্ষিগত করে রাখা যেমন অন্যায়, তেমনি তা অনর্থক খরচ করাও মহাপাপ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা পানাহার কর, কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ : ৩১)।

মিতব্যয়ের গুণ অপরিহার্য

মানুষের জীবনযাত্রায় মিতব্যয়ের গুণ অপরিহার্য। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচের মাধ্যমে মানুষ যেমন সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে বিবেচিত হয়, তেমনি সমাজে এর কুপ্রভাব বিস্তার করে। ফলে মানুষ ধ্বংসের মুখে পড়ে। এ বিষয়টি মানুষকে মিতব্যয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার দেয়া পবিত্র বস্তুগুলো খাও এবং এতে সীমালঙ্ঘন করো না; তাহলে তোমাদের ওপর আমার ক্রোধ নেমে আসবে। আর যার ওপর আমার ক্রোধ নেমে আসে, সে ধ্বংস হয়ে যায়।’ (সুরা তহা : ৮১)। অযথা মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় মিতব্যয়িতার পরিপন্থি এবং পাপের কাজ। মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের স্বভাব একবার গড়ে উঠলে তা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। এ অভ্যাস মানুষকে অন্যায় ও অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনে উদ্বুদ্ধ করে। আর অবৈধ উপায়ে উপার্জন ইসলামে হারাম।

মিতব্যয়ের মানে কৃপণতা নয়

অপব্যয় থেকে বিরত থেকে মিতব্যয়ী হওয়ার মানে কৃপণতা নয়। ইসলামে মিতব্যয়কে তাগিদ দিয়ে উৎসাহিত করলেও কৃপণতাকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি বদ্ধমুষ্ঠি হওয়া থেকে বিরত থাক এবং একেবারে মুক্তহস্তও হয়ে যেও না। যদি তা হও, তবে তুমি তিরস্কৃত ও অনুতপ্ত (নিঃস্ব) হয়ে পড়বে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৯)। অর্থ খরচের তিনটি অবস্থা- কার্পণ্য, মিতব্যয় ও অপব্যয়। কার্পণ্য ও অপব্যয়কে ইসলাম নিন্দা জানিয়েছে, আর মিতব্যয়কে উৎসাহিত করেছে। এ কারণে মিতব্যয় মধ্যমপন্থা ও উত্তম কাজ। আর অপব্যয় ও কার্পণ্য উভয়টিই নিন্দিত স্বভাব ও গোনাহের কাজ। যারা সঠিকভাবে ইসলামের বিধান পালন করেন, তারা অপব্যয় ও কার্পণ্যকে পরিহার করে মিতব্যয়ী হন। সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে থাকেন।

মিতব্যয়িরা প্রকৃত আল্লাহর বান্দা

যারা অপচয় এবং কৃপণতার পথ পরিহার করে মিতব্যয়িতার পন্থা অবলম্বন করবে, আল্লাহতায়ালা তাদের নিজের প্রকৃত বান্দা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘(রহমানের বান্দা তারাই) যারা অপব্যয়ও করে না, আবার কৃপণতাও করে না। তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী।’ (সুরা ফোরকান : ৬৭)। আল্লাহতায়ালার রীতি হলো, চেষ্টা ও উপায় অবলম্বনের ভিত্তিতে জীবিকা দান করা। তাই হালাল পন্থায় জীবিকা অর্জনের চেষ্টাকে ফরজ করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হালাল উপার্জনের সন্ধান অন্যান্য ফরজের পর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ।’ (সুনানে বাইহাকি : ৬/১২৮)।

পরিমিত ব্যয়ে কেউ নিঃস্ব হয় না

কৃপণতা না করে ইসলাম নির্দেশিত খাতে ব্যয়ে দ্বিধা না করা চাই। হারাম পথে খরচের সব পথ বন্ধ করে দিতে হবে। অপচয়-অপব্যয় না করার মাধ্যমে মিতব্যয়ী হলে আল্লাহতায়ালা দারিদ্র্যমুক্ত জীবন দান করবেন। এটি রাসুল (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পরিমিত ব্যয় করে, সে নিঃস্ব হয় না।’ (মুসনাদে আহমদ : ৭/৩০৩)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি অর্থ ব্যয়ে পরিমিতবোধের চর্চা করবে, অভাব-অনটন তার নাগাল পাবে না। ইসলামের এ মহান শিক্ষাটি যথাযথ অনুসরণ না করার কারণে মানুষ উপার্জনের যাচিত সুফল থেকে আজ বঞ্চিত। কৃপণতা ছেড়ে মিতব্যয়ী হয়ে সঞ্চয় করলে কোটিপতি হওয়া সম্ভব। ইসলাম এভাবে সঞ্চয় করে বিত্তশালী হতে নিষেধ করে না; বরং সঞ্চিত অর্থ থাকলেই তো অর্থনির্ভর আমলগুলো করা যায়। অর্থের প্রাচুর্য থাকলে জনকল্যাণমূলক নানা কাজে শরিক হওয়া যায়। সদকায়ে জারিয়ার অফুরন্ত ধারা চালু করা যায়। আবার উদ্ধৃত অর্থ যখন নেসাব পরিমাণ হয়ে বর্ষপূর্ণ হবে, জাকাতের মতো আরেকটি মহান ইবাদতেরও সুযোগ মেলে।

অর্থ সঞ্চয় করা ইসলামের শিক্ষা

অপচয় ও কৃপণতা- এ দু’প্রান্তিকতার মাঝখানে মধ্যমপন্থা হিসেবে মিতব্যয়ী হয়ে ভবিষ্যতের জন্য কিছু অর্থ সঞ্চয় করে রাখা ইসলামের শিক্ষা। পরিবার-পরিজনকে কারও মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়া নবীজি (সা.) পছন্দ করেননি। তিনি বলেছেন, ‘তুমি তোমার উত্তরাধিকারীদের মানুষের করুণার মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদের সচ্ছল রেখে যাবে; এটাই উত্তম।’ (বোখারি : ১/৪৩৫, মুসলিম : ৩/১২৫১)। ইসলাম সঞ্চয়কে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছে, তা আরও স্পষ্ট হয় রাসুল (সা.)-এর আরেক হাদিস থেকে। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম দান তা-ই, যা নিজ অভাবমুক্ততা রক্ষার সঙ্গে হয়।’ (বোখারি : ২/১১২)।

অপচয়ের ব্যাপারে কঠোরতা প্রদর্শন

পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে আল্লাহতায়ালা অপচয়ের ব্যাপারে কঠোরতা প্রদর্শন করেছেন এবং অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে অভিহিত করেছেন। অথচ এখন তা আমাদের সমাজের আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমোদণ্ডপ্রমোদ, বিভিন্ন অনুষ্ঠান কিংবা জৌলুস প্রদর্শনের নামে অপচয় করা আজ একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার (অপব্যয়) করার ক্ষমতা মানুষের আছে বটে; কিন্তু নৈতিক অধিকার নেই। কেননা, ধনীদের এ বিশাল অর্থসম্পদে সমাজের নিচু শ্রেণির হক রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্ছিতদের অধিকার রয়েছে।’ (সুরা জারিয়াত : ১৯)।

অপচয়ের ভয়াবহ পরিণাম

অপচয়কারীকে দারিদ্র্য দ্রুত ধরে ফেলবে। আর আল্লাহতায়ালা তাকে পথ প্রদর্শন করেন না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারী ও মিথ্যাবাদীকে পথ প্রদর্শন করেন না।’ (সুরা মোমিনুন : ২৮)। নিজের উপার্জিত টাকা নিজে যেভাবে ইচ্ছে খরচ করব, অপচয়-অপব্যয় করব, সমস্যা কী! এমন চিন্তা অনেকে করেন। অথচ উপার্জন ও খরচের ক্ষেত্রেও আমরা জবাবদিহির মুখোমুখি হব। উপার্জন হালাল হলেও তা হালাল পথে খরচ হয়েছে কি-না, অপচয়-অপব্যয়মুক্ত ছিল কি-না, সে ব্যাপারে হাশরের ময়দানে আল্লাহতায়ালার কাছে জবাব দিতে হবে। অপচয়-অপব্যয়ের কারণে আমার উপার্জিত সম্পদ যেন জাহান্নামে যাওয়ার কারণ না হয়, সে ব্যাপারে অবশ্যই সতর্কতা জরুরি। তা ছাড়া অপব্যয়কারীকে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ‘শয়তানের ভাই’ হিসেবে অভিহিত করে ভর্ৎসনা করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজনকে তার হক দাও এবং অভাবগ্রস্ত, মুসাফিরকেও। কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তো তার প্রতিপালকের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)।

অপচয় রোধে জাতীয় সম্পদ রক্ষা হয়

আমরা সচেতন হয়ে অপচয় বন্ধ করলে জাতীয়সম্পদ রক্ষা হবে। আমরা অপব্যয়ের গোনাহ থেকেও বেঁচে যাব। পাশাপাশি খরচ কমিয়ে অর্থ জমিয়ে দান-সদকা কিংবা ভালো কাজে খরচ করে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারব। যারা অপচয় এবং কৃপণতার পথ পরিহার করে মিতব্যয়িতার পথ অবলম্বন করবে, তারা আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কৃত হবেন। রাসুল (সা.) অপব্যয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ছিলেন। একবার তিনি সাদ (রা.)-কে অজুতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি খরচ করতে দেখে বললেন, ‘হে সাদ! অপচয় করছ কেন?’ সাদ (রা.) বললেন, ‘অজুতেও কি অপচয় হয়?’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, এমনকি প্রবহমান নদীতে বসেও যদি তুমি অতিরিক্ত পানি ব্যবহার কর, তাও অপচয়ের শামিল।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪২৫)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত