উপার্জন ও ব্যয়ে সতর্কতা
মুহাম্মদ ইকরামুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
অর্থ উপার্জন ও ব্যয় মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য-বস্ত্র-ওষুধের জোগান, বাসস্থান ব্যবস্থাপনাসহ নানা কাজে অর্থের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এ জন্য অর্থের জোগান ও জীবিকা নির্বাহের বিভিন্ন পথ বেছে নিতে হয় মানুষকে। এটা দুনিয়ার চিরাচরিত নিয়ম। নিজ ও পরিবারের প্রয়োজন পূরণে অর্থ উপার্জন ও ব্যয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নামাজ শেষে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক) তালাশ করো। আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো, যেন সফলকাম হও।’ (সুরা জুমা : ১০)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিজের উপার্জিত আহার সর্বোত্তম। তোমাদের সন্তানও নিজ উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৭৩৮)। রাসুল (সা.) আরও বলে, ‘কোনো ব্যক্তি তার পরিবারে যে অর্থ ব্যয় করে, তাও সদকা।’ (বোখারি : ৪০০৬)। এভাবে ইসলাম মানুষকে বৈধ উপার্জনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের প্রতি উৎসাহ ও প্রেরণা যুগিয়েছে; কাউকে বল্গাহীন স্বাধীনতা দেয়নি। অর্থ উপার্জন ও ব্যয়ে কিছু বিধি-নিষেধ ও নীতিমালা এঁটে দিয়েছে; যা অনুসরণে মানুষের পার্থিব ও পরকালীন কল্যাণ ও সফলতা নিহিত।
অর্থের মাধ্যমে পরীক্ষা
অর্থ-সম্পদের মালিকানার দিক থেকে দুনিয়ার সব মানুষ সমান নয়। কেউ ধনী, কেউ গরিব। এটা আল্লাহর ইচ্ছাধীন বিষয়। তিনি যাকে ইচ্ছে অর্থের প্রাচুর্য দান করেন, যাকে ইচ্ছে পার্থিব জীবনোপকরণ সংকীর্ণ করে দেন। অর্থ ও মর্যাদার দিক দিয়ে এ প্রাধান্য-পার্থক্যে আল্লাহর নিগূঢ় রহস্য লুকানো। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই তোমাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছেন। একে অন্যের ওপর মর্যাদা সমুন্নত করেছেন। যাতে তোমাদের সে বিষয়ে পরীক্ষা করেন, যা তোমাদের দিয়েছেন। আপনার প্রতিপালক দ্রুত শাস্তিদাতা এবং তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সুরা আনআম : ১৬৫)। তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা রিজিকের ক্ষেত্রে তোমাদের কাউকে অন্য কারও ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। যাদের অধিক দেয়া হয়েছে, তারা তাদের অধিনস্থদের তা থেকে দিতে সম্মত হয় না। যাতে তারাও তাদের সমপর্যায়ভুক্ত হতে পারে। তাহলে কি তারা আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি সুস্পষ্ট অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতে চায়!’ (সুরা নাহল : ৭১)।
বৈধ পথে উপার্জন
অর্থ-সম্পদের মালিকানার বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছাধীন। এর মাধ্যমে তিনি মানুষকে পরীক্ষা করেন ও মর্যাদা দেন। যা ক্ষণস্থায়ী এবং স্বল্পমেয়াদি। অতএব, অর্থ উপার্জনের আগে ভাবতে হবে, উপার্জনের এ মাধ্যম ও উৎস তার জন্য বৈধ কি-না! অর্থ উপার্জনে বৈধ পথ ও ইসলামি নির্দেশিকা অনুসরণ করা, অন্যায়ভাবে কারও অর্থ-সম্পদ গ্রাস করা ও অবৈধ পথে উপার্জন থেকে বিরত থাকা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা, তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না। শুধু তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয়, তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা কোরো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা তোমাদের প্রতি দয়ালু।’ (সুরা নিসা : ২৯)। তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা মাপ ও ওজন ঠিকভাবে দেবে। লোকদের তার প্রাপ্যবস্তু কম দেবে না। ভূপৃষ্ঠে শান্তি স্থাপনের পর বিপর্যয় ঘটাবে না। এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।’ (সুরা আরাফ : ৮৫)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘হে মোমিনরা, তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না। আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণ অর্জন করতে পারো।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩০)।
সঠিক খাতে ব্যয়
বৈধ পথে অর্থ উপার্জন ও সঠিক খাতে ব্যয় মোমিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ব্যাপারে তাগিদ দেয়া ও সচেতন থাকার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেয়া ছাড়া বনি আদমের পা একটুও সামনে বাড়বে না- জীবন কীভাবে কাটিয়েছে, যৌবনের শক্তি কোন কাজে লাগিয়েছে, অর্থ-সম্পদ কোন পথে উপার্জন করেছে, কোন পথে ব্যয় করেছে এবং জ্ঞাত বিষয় ও বিধানের ওপর কতটুকু আমল করেছে?’ (তিরমিজি : ২৪১৭)। জীবনযাপনে ইসলাম মানুষকে পরিমিত ব্যয় ও অপচয় রোধের নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার দেয়া পবিত্র বস্তুগুলো খাও এবং এতে সীমালংঘন করো না। নইলে তোমাদের ওপর আমার ক্রোধ নেমে আসবে। আর যার ওপর আমার ক্রোধ নেমে আসে, সে ধ্বংস হয়ে যায়।’ (সুরা তহা : ৮১)।
অর্থে অপচয় ও কার্পণ্য
অর্থের অপচয় যেমন মহাঅন্যায়, ঠিক তেমনি প্রয়োজনে অর্থ ব্যয়ে কার্পণ্য করাও গুরুতর অপরাধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে কৃপণতা করে ও বেপরোয়া হয় এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে, আমি তাকে কষ্টের বিষয়ের জন্যে সহজ পথ দান করব। যখন সে অধঃপতিত হবে, তখন তার সম্পদ তার কোনো কাজে আসবে না। আমার দায়িত্ব পথপ্রদর্শন করা। আর আমি ইহ-পরকালের মালিক। অতএব, আমি তোমাদের প্রজ্বলিত আগুন সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছি। এতে নিতান্ত হতভাগ্য ব্যক্তিই প্রবেশ করবে, যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।’ (সুরা লাইল : ৮-১৫)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘হে আদম সন্তান, তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় সাজসজ্জা গ্রহণ করে নাও, পানাহার কর; কিন্তু অপব্যয় কোরো না। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) অপব্যয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ : ৩১)।
ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের প্রত্যাশা
মানুষের জীবন-জীবিকায় ভারসাম্যপূর্ণ সুষম অবস্থা ও সামগ্রিক স্বচ্ছলতা বজায় রাখতে অর্থ উপার্জন ও ব্যয়ে মধ্যমপন্থা ও পরিমিত বোধের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিনরা যখন খরচ করে, তখন অপব্যয় করে না এবং কৃপণতাও করে না। তারা এতদুভয়ের মধ্যপন্থা অবলম্বন করে।’ (সুরা ফোরকান : ৬৭)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জীবন-জীবিকার মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার পরিচায়ক।’ (তাফসিরে কাবির : ১৯/৪২)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি পরিমিত ব্যয় করে, সে নিঃস্ব হয় না।’ (মুসনাদে আহমদ : ৩০৩)।