মূল্যস্ফীতির উল্লেখযোগ্য কারণ দুর্নীতি, সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনীতি, কালোবাজারি, মজুদদারি ও সিন্ডিকেট। যার প্রতিটিই ইসলামে নিষিদ্ধ। নীতির বিরুদ্ধে যে রীতি, সেটাই দুর্নীতি। ইসলামের দৃষ্টিতে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, সুদণ্ডঘুষ, জুয়া তথা যেকোনো হারাম পন্থা অবলম্বন, ক্ষমতা ও পেশীশক্তির অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, প্রতারণা, আইনের অসৎ ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল এবং দেশ-জাতি ও সাধারণ নাগরিকের স্বার্থ ও অধিকার হরণ করার নাম দুর্নীতি। হালাল রিজিক অন্বেষণ ও হারাম উপার্জন থেকে নিজেকে নিবৃত্তকরণ স্বভাবে পরিণত হলে দুর্নীতি দমন সহজ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের যে হালাল ও উৎকৃষ্ট রিজিক দিয়েছেন, তা থেকে খাও এবং ভয় করো আল্লাহকে, যার প্রতি তোমরা বিশ্বাসী।’ (সুরা মায়িদা : ৮৮)।
দুর্নীতির ভয়াবহ পরিণাম
ইসলাম অপরাধী ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পার্থিব শাস্তি প্রদানের স্বচ্ছ আইন এবং তা দ্রুত কার্যকর করার বিধান প্রণয়ন করেছে। ইসলাম কোনো অপরাধী ও দুর্নীতিবাজকে ছাড় দেয়নি। ছাড় দিলে অপরাধীদের ভবিষ্যতে আরও অপরাধ প্রবণতার সুযোগ থেকে যায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (সুনানে নাসাঈ : ৪৮৯১)। দুর্নীতির ভয়াবহ পরিণাম রয়েছে ইসলামে। দুনিয়াতে অপরাধের শাস্তি হোক বা না হোক, পরকালে নিশ্চিত বিচার হবে, এ মানসিকতা থাকা চাই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেব। তাদের হাত আমার সঙ্গে কথা বলবে, তাদের পা তাদের কৃতকর্মের কথা বলবে।’ (সুরা ইয়াসিন : ৬৫)।
ইসলামে দুর্নীতি দমনের নির্দেশ
দুর্নীতি দমনে জনপ্রতিনিধি, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ জনগণের মধ্যে ইসলামি মূল্যবোধ ও তাকওয়ার ব্যাপক অনুশীলন প্রয়োজন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘লোকালয়ের মানুষগুলো যদি ঈমান আনত ও তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করত, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দ্বার খুলে দিতাম।’ (সুরা আরাফ : ৯৮)। দুর্নীতি দমনের মূলনীতি হিসেবে ইসলাম হালাল-হারাম ও পবিত্র-অপবিত্রের মাঝে সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য বর্ণনা করেছে। হালালের কল্যাণ-উপকারিতা, হারামের অকল্যাণ-অপকারিতা স্পষ্ট করে দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানবকুল! পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তুসামগ্রী খাও। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা : ১৬৮)। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেও কঠোর হস্তে অপরাধ ও দুর্নীতি দমনের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যদি অন্য কাউকে অন্যায় কাজ করতে দেখে, তাহলে সে যেন তার শক্তি দ্বারা তা প্রতিহত করে। যদি সে এতে অক্ষম হয়, তাহলে মুখ দ্বারা নিষেধ করবে। যদি সে এতেও অপারগ হয়, তাহলে সে অন্তরে ঘৃণা পোষণ করবে।’ (মুসলিম : ১৬৮)।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আবদ্ধকারী অভিশপ্ত
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য আটকে রাখা ও মূল্যবৃদ্ধির অপেক্ষা করা এবং মূল্য বেড়ে গেলে বাজারে ছাড়া ও অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করাকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘ইতহিকার’ বলে। রাসুল (সা.) এ জাতীয় প্রহসনের প্রতি তীব্র অসন্তোষ ব্যক্ত করে বলেন, ‘যে ব্যবসায়ী পণ্য আবদ্ধ বা স্তূপ করে রাখে, সে গোনাহগার।’ (মুসলিম : ১৬০৫)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আবদ্ধকারী কতই না মন্দ! যদি পণ্যদ্রব্যের মূল্য কমে যায়, তাহলে সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়। আর যদি মূল্য বেড়ে যায়, সে আনন্দিত হয়।’ (বায়হাকি : ৭/৫২৫)। যে ব্যবসায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আবদ্ধ করে না, বরং সময়মতো বাজারে পণ্য নিয়ে আসে, সে আল্লাহর রহমত পাওয়ার অধিকারী, তাকে আল্লাহ রিজিক দেবেন। আর নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের আবদ্ধকারী অভিশপ্ত। গুদামজাত করা, কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ভোক্তা-সাধারণকে বিপদে ফেলে পণ্যের দাম বাড়ানো গর্হিত কাজ। পরিকল্পিতভাবে জোটবদ্ধ হয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়াও সীমাহীন অন্যায়। মূল্যস্ফীতির প্রতিকারে সরকার ও ভোক্তাশ্রেণীকে এসব দুর্নীতি দমনে সোচ্চার হতে হবে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে করণীয়
চলমান অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে সরকার ও জনগণকে যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। বাজেট, রমজান, ঈদ, পূজা, দুর্যোগ ইত্যাদি সময়ে ব্যবসায়ী মহল পণ্য সরবরাহের ঘাটতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কথা বলে। অপরদিকে দেশের একদল অসাধু ব্যবসায়ী নিজেদের সুবিধামতো বিপুল পরিমাণ পণ্য গুদামজাত করে বাজারে উদ্ভট কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। তারা সিন্ডিকেট গঠন করে ইচ্ছেমতো পণ্যের মূল্য হাঁকিয়ে বসে। তাদের এ বর্ধিত মূল্য আদৌ যুক্তিযুক্ত কিনা? সরকারের পক্ষ থেকে তা খতিয়ে দেখে সঠিক মূল্য নির্ধারণ করার মতো মনিটরিং টিম সদা তৎপর থাকতে হবে। বাজারে দ্রব্যমূল্য অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বৃদ্ধি পাওয়া ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করা দরকার। করোনা পরিস্থিতিসহ দেশের চলমান অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারকে প্রয়োজনে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। অতিলোভী অসাধু আড়ৎদার ও মজুদদারের দুর্নীতি শক্ত হাতে দমন করতে হবে। প্রতিটি বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য তালিকা টাঙাতে বণিক সমিতির প্রতি কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। মূল্যতালিকার নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণের জন্য সব বাজারে দ্রব্যমূল্য মনিটরিং কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বাজার মনিটরিং করতে হবে। সাধারণ জনগণকে ঘরোয়া মজুদ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্বস্ততা, নৈতিকতা ও সততার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ক্রমাগত কমে যাওয়া রোধ করা সরকারের উচিত। অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রধান প্রধান নিত্যপণ্যের জন্য বিদেশের বাজারের ওপর নির্ভরশীল থাকায় বাংলাদেশ সব সময় আমদানি-প্ররোচিত মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিতে থাকে। ফলে কিছু দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশের একমাত্র উপায় হচ্ছে, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য নিজস্ব সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরি করা। পাশাপাশি দামের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, এমন লোকজনকে সরকারি সহায়তা হিসেবে নিজস্ব স্টক থেকে কিছু নিত্যপণ্য সরবরাহ করা বা ভর্তুকি দেয়া। খুচরা বাজারে সরকারের মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এসব পণ্য বিক্রির ব্যাপারে জরুরি ব্যবস্থা নেয়া চাই।