জাকাত শোকরিয়া আদায়ের মাধ্যম
তাবাসসুম মাহমুদ
প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দারিদ্র্য ও প্রাচুর্য দু’টি বিপরীতধর্মী শব্দ। কিন্তু মানব জীবনে দু’টিই জড়িয়ে আছে অন্ধকার এবং আলোর মতো। এইতো প্রাচুর্যের ছন্দময় উপস্থিতি, আবার কিছু সময় পরই দারিদ্র্যের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়াল থাবা। কারও কারও জন্য প্রাসাদোপম আলীশান বাড়ি, বিলাশ বহুল গাড়িসহ সুখের সব রকম সরঞ্জামাদির বিপুল সমাহার; আবার কারও কারও ক্ষেত্রে হাড়ভাঙা খাটুনি পরিশ্রমের পরও দু’মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা নেই, নেই মাথাগোজার একটু ঠাঁই। দু’টি অবস্থাই প্রজ্ঞাময় মহামহীমের সৃষ্টি। ইবাদতের দু’টি অনুপাত ধারা সৃষ্টিই এর মূল রহস্য। একটি সবর, অন্যটি শোকর। দু’টিই আল্লাহতায়ালার বিশেষ ইবাদত। দু’টির মাধ্যমেই রয়েছে মহামহীম রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জনের সুনিপুণ ব্যবস্থা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মোমিনের বিষয়টি অতিশয় বিস্ময়কর। তার প্রত্যেকটি বিষয়ই তার জন্য কল্যাণকর। আর এটি একমাত্র মোমিনের জন্যই। যদি তার সুদিন আসে, সমৃদ্ধি অর্জিত হয়, তাহলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এটি তার জন্য কল্যাণকর। আবার যদি দুর্দিন আসে, দারিদ্র্যে আক্রান্ত হয়। ধৈর্যধারণ করে এটিও তার জন্য কল্যাণকর।’ (মুসলিম : ৭৪২৫)। হাদিস থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায়, দারিদ্র ও প্রাচুর্য দু’টিই আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের দু’টি সহজ পন্থা। দরিদ্র ধৈর্য ধারণ করবে, আর ধনবান শোকরিয়া আদায় করবে। মানব জীবনে দু’টি সুযোগই কারও কারও ক্ষেত্রে আসতে পারে, আবার কেউ এর যে কোনো একটি সুযোগপ্রাপ্ত হতে পারে। তবে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হলো, যখন যার যে সুযোগ আসে, তখন তাকে কাজে লাগিয়ে সুযোগের সৎ ব্যবহার করা।
সম্পদকে আল্লাহর অনুগ্রহ বলে জ্ঞান করা
ধন-সম্পদ নিজের কৃতিত্বের ফসল নয়, বরং তা মহামহীমের দয়া ও ইচ্ছার ফসল। তাই প্রথমত, সর্বান্তকরণে তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই তাকে ভুলে যাওয়া চলবে না। তার বিধি-নিষেধের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন চলবে না। নিজের ইচ্ছার ওপর তার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তার দাবির কাছে নিজের ইচ্ছাকে বিলীন করে দিতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিনরা! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি যেন তোমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সুরা মোনাফিকুন : ৯)। আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, সম্পদ মানুষকে আল্লাহবিমুখ করে দেবে এমন আশঙ্কা আছে, তাই মোমিনদের সদা সতর্ক থাকতে হবে। এ সম্পদ যেন কোনোক্রমেই তাকে তার সৃষ্টিকর্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে না পারে। সম্পদের মোহ যেন আল্লাহর দাবিকে গৌণ করতে না পারে। আর সেটি তখনই সম্ভব, যখন সম্পদপ্রাপ্ত ব্যক্তি এ সম্পদকে আল্লাহর অনুগ্রহ বলে জ্ঞান করবে।
অসহায়ের জন্য সম্পদ ব্যয় করা আল্লাহর নির্দেশ
সম্পদের ব্যাপারে আল্লাহর যে নির্দেশ, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার প্রাণান্তকর চেষ্টা অব্যাহত রেখে খেয়াল রাখতে হবে, প্রাচুর্যের কারণে গতি যেন পাল্টে না যায়। সম্পদ যেন হারাম ও অনৈতিক কাজে ব্যয় না হয়। বরং এ ব্যাপারে আল্লাহর যে নির্দেশ, তা যেন ঠিক ঠিক পালন করা হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের সম্পদে অধিকার রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের।’ (সুরা জারিয়াত : ১৯)। এ আয়াত সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে অসহায়, বঞ্চিত ও প্রার্থীদের জন্য সম্পদ ব্যয় করা আল্লাহর দাবি ও নির্দেশ।
সম্পদ ব্যয় করার সুফল ও না করার কুফল
আল্লাহর নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় সহায়ক হবে, তা গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করা চাই। আর তা হচ্ছে, সম্পদ ব্যয়ের যে ফজিলত কোরআন-সুন্নাহে বর্ণিত হয়েছে, তা স্মরণে আনা এবং ব্যয় না করে কুক্ষিগত করার মন্দ পরিণতির কথা বিবেচনা করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিনরা সফলকাম হয়েছে, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র, যারা অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত, যারা জাকাত দান করে থাকে।’ (সুরা মোমিনুন : ১-৪)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘এরাই প্রকৃত উত্তরাধিকারী। যারা উত্তরাধিকার লাভ করবে শীতল ছায়াময় উদ্যানের। তাতে তারা চিরকাল থাকবে।’ (সুরা মোমিনুন : ১০-১১)। তাহলে আল্লাহর নির্দেশমতো সম্পদ ব্যয় করলে পরকালে চিরন্তন জীবনের জন্য চিরসুখময় জান্নাতপ্রাপ্তি নিশ্চিত। অল্প সম্পদ ব্যয় করলে পরপারে তা অনেক বড় করে পাওয়া যাবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা সদকা (দান) কবুল করেন এবং তা তাঁর ডান হাতে গ্রহণ করে থাকেন। এরপর তাকে লালনপালন করতে থাকেন, যেমনিভাবে তোমাদের কেউ স্বীয় জন্তুশাবক লালনপালন করে থাক। এমনকি এক লোকমা খাবার (তার লালনপালনের কারণে) পাহাড়ের মতো বিশাল হয়ে দেখা দেবে। অতএব, তোমরা সদকা কর।’ (মুসনাদে আহমদ : ৭৩১৪)। পক্ষান্তরে ব্যয় না করে জমা করে রাখলে সে সম্পদ পরকালের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা স্বর্ণ ও রুপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে না, তাদের কঠোর আজাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন, যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে। (আর বলা হবে) এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে। সুতরাং এর স্বাদণ্ডআস্বাদ করো।’ (সুরা তওবা : ৩৫)। সম্পদ ব্যয় না করে জমা করে রাখার ভয়াবহতা কত মারাত্মক, সে প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যাকে সম্পদ দিলেন, কিন্তু সে তার জাকাত আদায় করল না, তার সম্পদ কেয়ামতের দিন বিষধর সাপে রূপান্তরিত করা হবে, সাপের দু’পার্শ্বে তিলক থাকবে। ওই সাপ তার দু’চোয়াল ধরে দংশন করবে আর বলবে, আমিই তোমার সম্পদ, আমিই তোমার সঞ্চিত ধন-ভাণ্ডার।’ (মুসলিম : ২৪৬)। ধনবান ব্যক্তি তার অপর মুসলমান ভাইয়ের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের সুযোগ সন্ধান করবে, এতে নিজেরই লাভ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যারা দয়াশীল, দয়াময় রব তাদের প্রতি দয়া করেন। যারা জমিনে বিচরণ করে, তাদের প্রতি দয়া কর। যিনি আকাশে আছেন, তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (তিরমিজি : ১৯৪৭)।
সহানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে শোকরিয়া জ্ঞাপন
নিয়মিত জাকাত আদায় করে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করলে সামাজিক নানান কর্মকাণ্ডে অবদান রাখা যায়। সম্পদের প্রতি মানুষের মোহ প্রকৃতিগত। সম্পদ উপার্জনে মানুষ আগ্রহ বোধ করে, কিন্তু ব্যয়ের ব্যাপারে অনুরূপ সাচ্ছন্দ অনুভব করে না। আর সাহায্য-সহানুভূতি ও দান-খয়রাত রীতিমতো মনের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রাম। এ ক্ষেত্রে জাকাত আদায়েচ্ছু ব্যক্তি যদি জাকাত আদায়ে শরিয়তের বিধান স্মরণে আনে, তাহলে তার জন্য সামাজিক কাজে সফল হওয়া সহজ হবে। অর্থাৎ জাকাত আদায় ইসলামের মূলভিত্তি, এটি ছাড়া ইসলাম পরিপূর্ণ হয় না। জাকাত মূলত তার সম্পদ নয়, বরং দারিদ্র্র্যকিষ্ট বঞ্চিত ও প্রার্থীদের সম্পদ; যা তার সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের সম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার।’ (সুরা জারিয়াত : ১৯)। তাহলে জাকাত আদায় না করা প্রকারান্তরে আল্লাহর বিধান লংঘন করার পাশাপাশি অন্যের অধিকার নষ্ট করা। জাকাত আদায়ে সম্পদ বৃদ্ধি পায়, কলুষমুক্ত হয়। জাকাত আদায়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত নিশ্চিত হয়। জাকাত আদায়ে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। পরকালে জাহান্নামে যেতে হবে। সম্পদ বিষধর সাপে রূপান্তরিত করে গালদেশে ঝুলিয়ে দেয়া হবে। উক্ত সর্পরূপী সম্পদ তিরস্কারসহ দংশন করে চলবে। জাকাত আদায়ের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে অংশগ্রহণ করে একটি অধঃপতিত জাতিকে স্বনির্ভর ও স্বাধীন জাতিতে উন্নত করা যায়। দারিদ্র্যকিষ্ট হয়ে ঈমান হারাতে বসা চরম বিপর্যস্ত একটি গোষ্ঠীকে জাকাত আদায়ের মাধ্যমে এমন বিপদ থেকে রক্ষা করা যায়। সব বিপদ মোকাবিলায় জাকাতের ভূমিকা অপরিসীম। আজ যদি জাকাত আদায়ের সুষ্ঠু নীতিমালা থাকত, বণ্টনের ইনসাফভিত্তিক ব্যবস্থা থাকত, তাহলে অবস্থা হয়তো এত করুণ হতো না। যদি দেশের ধনবান ব্যক্তিবর্গ হৃদয় দিয়ে সহানভূতির সঙ্গে একটু চিন্তা করেন, তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায়, দেশি-বিদেশি সুবিধালোভী সুদ ব্যবসায়ী আধিপত্যবাদীরা লেজ গুটাতে বাধ্য হবে। আমাদের এ আশা কল্পনা নির্ভর নয়, বরং যুক্তির নিরিখে একটু হিসাব করি।