রমজানের বিশেষত্ব

রমজানুল মোবারকের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য অপরিসীম। এ মাসে বৃষ্টির মতো বর্ষিত হয় রবের রহমধারা। মাগফিরাতের বন্যায় ভেসে যায় গোনাহের আবর্জনা। মুক্তি মেলে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে। মোমিনের জন্য এটি বোনাসের মাস। ফসল তোলার মাস। ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আজকার ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মোমিন এ মাসে পৌঁছে যায় রবের বিশেষ সান্নিধ্যে। জাগতিক চাহিদা, লোভ-লালসা ও অপরাধের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে ঈমানের দীপ্ত স্বাদ অনুভব করেন বিশেষভাবে। এ মাসের রয়েছে কিছু বিশেষত্ব; তা নিয়ে লিখেছেন- আবদুল আউয়াল

প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রহমতের মাস

নবীজি (সা.) বলেন, ‘যখন রমজান মাস আসে, তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়।’ (বোখারি : ১৮৯৮)। অন্য হাদিসে এসেছে, একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকেন, ‘হে কল্যাণকামী, আগে বাড়ো! হে পাপী, এবার থাম!’ আর আল্লাহতায়ালা এ মাসের প্রতি রাতে অসংখ্য জাহান্নামিকে মুক্তি দান করেন। (তিরমিজি : ৬৮২)।

কোরআন নাজিলের মাস

মাহে রমজান দামি হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, এ মাসেই পূর্ণ কোরআন মাজিদ লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ হয় এবং নবীজি (সা.)-এর ওপর এ মাসেই (প্রসিদ্ধ মতানুসারে ১৭ রমজান) প্রথম অহি- সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত নাজিল হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রমজান মাস, এতে নাজিল হয়েছে আল কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সুপথ প্রাপ্তির সুস্পষ্ট পথনির্দেশ ও হক-বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের যে কেউ এ মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই এর রোজা রাখে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)।

সিয়ামণ্ডকিয়ামের মাস

রমজান সিয়ামণ্ডকিয়ামের মাস। সিয়াম মানে সুবহে সাদিক থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার, যৌনাচার ও যাবতীয় অশালীন কাজ থেকে বিরত থাকা। আর কিয়াম মানে রাতের নফল নামাজ তথা তারাবি-তাহাজ্জুদ। সিয়াম ফরজ আর কিয়াম সুন্নত। সিয়াম সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা, তোমাদের ওপর রমজানের সিয়াম ফরজ করা হয়েছে; যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)। নবীজি (সা.) বলেন, ‘বরকতময় রমজান মাস তোমাদের কাছে এসেছে। আল্লাহতায়ালা এ মাসের রোজা তোমাদের ওপর ফরজ করেছেন।’ (সুনানে নাসায়ি : ২৪১৬)। সিয়ামের ফজিলত সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের হালতে সওয়াবের নিয়তে রমজানের সিয়াম পালন করবে, তার আগের গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (বোখারি : ৩৮)। কিয়াম বা রাতের নফলের বিষয়ে হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের হালতে সওয়াবের নিয়তে রমজানের রাতে নামাজে দাঁড়াবে, তার আগের গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (বোখারি : ৩৬)।

দোয়া কবুল ও মুক্তির মাস

এ মাসের বিশেষ বিশেষ প্রহরে দোয়া যেমন কবুল হয়, তেমন জাহান্নাম থেকেও অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন মুক্তি লাভ করতে থাকে। হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহতায়ালা রমজানের প্রত্যেক দিন ও রাতে অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন ও প্রত্যেক মোমিন বান্দার একটি করে দোয়া কবুল করেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ৭৪৫০)। অপর এক হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহতায়ালা প্রতিদিন ইফতারের সময় অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ২২২০২)।

দানের মাস

দান-সদকা এমনিতেই মোমিনের ভালো আমল, কল্যাণকর বিষয়। কিন্তু রমজানে তার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, নবীজি (সা.) ছিলেন মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠদাতা। তার দানের পরিমাণ রমজান মাসে অনেক বেড়ে যেত, যখন জিবরাইল (আ.) তার সঙ্গে এসে সাক্ষাৎ করতেন। (মুসলিম : ২৩০৮)।

সওয়াব বৃদ্ধির মাস

উম্মতে মুহাম্মদির আমলের সওয়াব বেশি দেখানো ও তাদের বিশেষ মর্যাদা দিতে আল্লাহতায়ালা এ মাসকে বিশেষ বোনাস হিসেবে তাদের দান করেছেন। হাদিসে এসেছে, ‘এ মাসে ওমরা করলে তা হবে হজের সমান।’ (তিরমিজি : ৯৩৯)। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘রমজান মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল আদায় করবে, তা ফরজের সমান হবে। আর যে একটি ফরজ আদায় করবে, তা সত্তরটি ফরজের সমান হবে।’ (শোআবুল ঈমান : ৩/৩০৫-৩০৬)।

পাপ মোচনের মাস

এ মাসে মোমিন তার পাপরাশি মোচন করে পুতঃপবিত্র হতে পারে। হাদিসে এসেছে, ‘রমজানের রোজা এক রমজান আরেক রমজানের মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহগুলোকে মুছে দেয়, যদি সে কবিরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে।’ (মুসলিম : ২৩৩)। এমন সুযোগ পেয়েও যে ব্যক্তি নিজের পাপগুলো ক্ষমা করাতে পারে না, সে বড়ই হতভাগা। হাদিসে এসেছে, একবার প্রিয়নবী (সা.) মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে বললেন, আমিন! দ্বিতীয় ও তৃতীয় সিঁড়িতে পা রেখেও বললেন, আমিন! তখন সাহাবায়ে কেরাম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আজ আমরা আপনাকে এমন কিছু বলতে শুনেছি, যা এর আগে কখনও শুনিনি।’ উত্তরে তিনি বললেন, জিবরাইল (আ.) আমার কাছে আগমন করেছিলেন, যখন আমি প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন তিনি বললেন, ‘ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যে রমজান মাস পেল আর তার গোনাহ মাফ করাতে পারল না।’ আমি তখন বললাম, ‘আমিন।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ৭৩৩৮)।

লাইলাতুল কদরের মাস

রমজানের শেষ দশকে আছে মহিমান্বিত রাত ‘লাইলাতুল কদর’। যে রাতে কেউ ইবাদত করলে মিলবে ৮৩ বছর ৪ মাস অপেক্ষা বেশি দিন ইবাদতের সওয়াব। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে ফেরেশতারা ও রুহ (জিবরাইল) তাদের পালনকর্তার আদেশক্রমে প্রত্যেক কল্যাণময় বস্তু নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করে। যে রাত পুরোটাই শান্তিতে ভরপুর থাকে ফজর হওয়া পর্যন্ত।’ (সুরা কদর : ২-৫)। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে প্রকৃতপক্ষে সব কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো। একমাত্র দুর্ভাগাই এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৬৪৪)।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া সিদ্দিকিয়া কুলিয়ারচর, কিশোরগঞ্জ