ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অর্থনীতির গল্প

প্রথম খলিফার প্রথম যুদ্ধ

জাকারিয়া মাহমুদ
প্রথম খলিফার প্রথম যুদ্ধ

কয়েকদিন হলো আবু বকর (রা.) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এরই মধ্যে চতুর্দিক থেকে ধেয়ে এলো ফেতনা। এর অন্যতম হলো, ইসলামের ফরজ বিধান জাকাত অস্বীকার। আবস, জুবিয়ান, বনু ফাজারা, বনু গাতফান, তামিম ও তায়ীসহ বেশকিছু গোত্র জাকাত দেবে না বলে বেঁকে বসল। অথচ সবাই রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় ঠিকই পাই পাই হিসাব করে জাকাত দিয়েছে। এখন তাদের বক্তব্য হলো, জাকাত মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সম্পর্কিত। আর তিনি পরলোক গমন করেছেন, তাই জাকাত আদায়ের প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া আবস ও জুবিয়ান গোত্রের লোকেরা মিথ্যা নবুওয়তের দাবিদার তোলাইহার কথায় প্ররোচিত হয়ে কিছু ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে হত্যা করে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করল। ইসলাম ত্যাগের জন্য তাদের চাপ দিল। তার ওপর জাকাত আদায়কারীদের ওপর নির্যাতন চালাল। এ গোত্রদ্বয় চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে জাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দূত পাঠাল, যেন তাদের জাকাত হতে অব্যাহতি দেয়া হয়।

জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে

যুদ্ধ ঘোষণা

পরিস্থিতির নাজুকতা লক্ষ্য করে ও চতুর্মুখী সংকটের দিকে তাকিয়ে কয়েকজন সাহাবি সাময়িক কর্মকৌশল হিসেবে আবু বকর (রা.)-কে পরামর্শ দিল, ‘ফিলহাল তাদের এ দাবি বিবেচনা করে জাকাতের ব্যাপারে তাদের ছাড় দেয়া হোক।’ ওমর (রা.)-এর মতো উঁচু মনোবলসম্পন্ন সাহসী মানুষটিও এ পরামর্শ দিলেন। এসব কথা ভেবে ও পরিবেশ-প্রতিবেশের স্পর্শকারতা লক্ষ্য করে উম্মাহর সবচেয়ে নরম ব্যক্তিটি গরম হয়ে গেলেন। বিবর্ণ হয়ে গেল ক্ষোভে ও ক্রোধে তার নুরানি চেহারা। রাজনৈতিক কর্মকৌশল ও সাময়িক প্রয়োজন উপেক্ষা করে অবিকৃত রূপ বহাল রাখতে তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ী। বাঘের ন্যায় গর্জে উঠে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘আল্লাহর কসম! যে ব্যক্তি জাকাতকে নামাজের সমান গুরুত্ব দেবে না, আমি অবশ্যই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। নবীজি (সা.)-এর যুগে যে ব্যক্তি একটি বকরির শাবক?ও জাকাত দিত, আজ যদি সে তা অস্বীকার করে, তাহলে আমি তরবারির জোরে তার থেকে তা আদায় করব।’ (বোখারি : ৩০৯১)।

আপোসহীন আবু বকর (রা.)

জাকাত হচ্ছে ইসলামের মৌলিক ফরজগুলোর একটি। যে সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা অসংখ্য আয়াত অবতীর্ণ করেছেন, রাসুল (সা.)-এর একাধিক বাণী রয়েছে। এ জন্য তিনি এই ফরজ বিধান বর্জনের ব্যাপারে আপোস করতে রাজি হননি। যেখানে তাদেরকে দ্বীনি ভাই হওয়ার গণ্ডি থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে, যাদের সঙ্গে রাসুল (সা.) জিহাদ করতে আদিষ্ট হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে আপোস কীসের! আবু বকর (রা.) ছিলেন হামদর্দি, সমব্যথী ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী। আর জাকাত আদায় না করার যে আজাব আল্লাহর কালাম ও রাসুল (সা.)-এর জবানে উম্মাহ জেনেছে, তার ভয়াবহতা স্মরণে তিনি ছিলেন অস্থির। তিনি ভাবলেন, উম্মাহর বিষবৃক্ষ নামক এ আগাছাগুলো পরিষ্কার করতে পারলে রাসুল (সা.)-এর আনীত ইসলামকে অবিকৃত রাখা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে সামাজিকতাও অক্ষুণ্ন থাকবে।

সতর্ক থাকার আদেশ জারি

খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি প্রথমে রাসুল (সা.)-এর প্রস্তুতকৃত ওসামাবাহিনীকে সিরিয়ায় প্রেরণ করেন। ওসামা ইবনে জায়েদ (রা.)-এর বাহিনী রওনা হলে মদিনার সামরিক নিরাপত্তা যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন বিভিন্ন ধর্মত্যাগী সম্প্রদায় মদিনার আশপাশে সংঘবদ্ধ হতে শুরু করল। মদিনায় উত্তর দিক থেকে আবস ও জুবিয়ান, উত্তর-পূর্ব দিক থেকে বনু ফাজারা এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে বনু গাতফানের মুরতাদবাহিনী হামলে পড়ল। নগরীর নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ লক্ষ্য করে আবু বকর (রা.) দ্রুত সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সবগুলো সড়ক ও অলিগলির মুখে শক্ত পাহাড়ার ব্যবস্থা করেন। মদিনার প্রত্যেক নাগরিককে ২৪ ঘণ্টা সতর্ক থাকার আদেশ জারি করেন।

বীরবেশে বেরিয়ে পড়লেন

৪০ দিন পর ওসামা (রা.) বিজয়ের পতাকা পতপত করে উড়িয়ে ফিরলে আবু বকর (রা.) তাকে মদিনায় তার স্থলাভিষিক্ত করলেন। এরপর নিজে সৈন্যদল নিয়ে জাকাত অস্বীকারকারীদের দমনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। তখন সাহাবায়ে কেরাম খুব পীড়াপীড়ি করে বললেন, ‘খলিফাতুল মুসলিমিন! আপনি বেরুবেন না। এ মুহূর্তে আপনার রাজধানীতে অবস্থান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ কিন্তু তিনি তাদের বারণ না শুনে সৈন্যদল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সময়টা ছিল ১১ হিজরির জুমাদাল উখরার শেষ সপ্তাহ। আবস ও জুবিয়ান বনু ফাজারা ও বনু কিনানার দুষ্কৃতিপরায়ণ ফেতনাবাজরা তখনও মদিনার চতুর্দিকে ওত পেতে বসেছিল।

লাশের স্তূপ ফেলে পালাল

আবু বকর (রা.) ভোরের আলো ফোটার আগেই অকস্মাৎ আক্রমণ করে তাদের আস্তানা জ্বালিয়ে দিলেন। তাদের রসদসামগ্রী ধূলিস্যাৎ করে দিলেন। দুষ্কৃতিকারীরা হঠাৎ তাকে সামনে পেয়ে একদম ভড়কে গেল। সুযোগ বুঝে মুসলিমবাহিনী তাদের ওপর বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সূর্যের কিরণ পুরোপুরি প্রকাশিত হওয়ার আগেই দুষ্কৃতিকারীরা লাশের স্তূপ ফেলে কোনোমতে পড়িমড়ি করে পালাল। এ যুদ্ধ যুলকাশা নামক প্রান্তরে সংঘটিত হওয়ায় ইতিহাসে এটা যুলকাশার যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ। এভাবে আবু বকর (রা.) বিরোধীদের ঐক্য ও সংবদ্ধতা বিনাশ করেন। (তারিখু খলিফা লিবনি খাইরাত : ১০১, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৯/৪২৪, ফাতহুল কাদির : ২/১৬৩)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত