ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইসলামে হজ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

হজ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও সাম্যের সপ্রতিভা প্রতীক। ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ পবিত্র হজ পালনে সৌদি গমন করেন। সেখানে গিয়ে তারা আল্লাহপ্রেমের পাঠ চুকিয়ে রাসুলপ্রেমের ষোলকলা পূর্ণ করেন। হজে আর্থিক ও কায়িক উভয় ইবাদতের সমন্বয় রয়েছে; অন্য কোনো ইবাদতে যা একসঙ্গে পাওয়া যায় না। এ মহাসৌভাগ্য ও পুণ্যের মিছিলে শামিল হতে বড় অঙ্কের অর্থ গুনতে হয় হজযাত্রীদের। এ অর্থ ব্যয় কি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ব্যবস্থায় ঘাটতি ফেলে? এ নিয়ে নানাজনের নানা মত। কিন্তু এ ব্যাপারে ইসলামের ভাষ্য কী? তা নিয়ে লিখেছেন - মিনহাজুল আরিফীন
ইসলামে হজ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

মুসলিমমাত্রেই বিশ্বাস করেন, তার আয়-উপার্জন, জীবন-মৃত্যু, সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য ইত্যাদি নির্ধারণ হয়ে যায় পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই। এগুলো তিনি লাভ করেন তার জন্য বরাদ্দ সব উপায়-উপকরণের মাধ্যমে। তবে কারও সীমিত রিজিকের মধ্যেই আল্লাহতায়ালা দান করেন বিপুল কল্যাণ ও বরকত। আবার কারও অঢেল সম্পদের ধনকুবের বানিয়েও জড়িয়ে রাখেন নানা অকল্যাণের বেড়াজালে। আমরা না বুঝে অর্থ খরচের ভয়ে এবং মালের মহব্বতে আল্লাহর ঘর দেখতে বিলম্ব করি। হজ-ওমরায় যেতে বোকার মতো টাকার খরচের কথা বারবার চিন্তা করি। অথচ হজে শুধু পরকাল নয়, বরং ইহকালীন কল্যাণও হাসিল হয়। হজ ও ওমরা পাপ মোচনের পাশাপাশি হজকারী ও ওমরাকারীর অভাব-অনটনও দূর করে। এতদুভয়ের মাধ্যমে সম্পদ শুধু ব্যয় হয় না; বরং তা বাড়েও বটে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা হজ-ওমরা সঙ্গে সঙ্গে কর। কেননা, এ দুটি দারিদ্র্য ও গোনাহ এভাবে দূর করে, যেভাবে হাঁপর লোহা ও সোনা-রুপার ময়লা দূর করে। আর মকবুল হজের বিনিময় একমাত্র জান্নাত।’ (তিরমিজি : ৮১৫)।

হাজিদের অভাব হয় না

হজের উদ্দেশ্য হচ্ছে, অতীতের পাপ মোচন ও ভবিষ্যতে তাকওয়ার মাধ?্যমে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন। কারণ, আল্লাহতায়ালা হজের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের ওপর হজকে আরোপ করে নিল, তার জন্য হজে অশ্লীল, পাপাচার ও ঝগড়া-বিবাদ করা বৈধ নয়। তোমরা ভালো কাজ যা কর, আল্লাহ তা জানেন এবং পাথেয় গ্রহণ কর। নিশ্চয় উত্তম পাথেয় তাকওয়া। হে বিবেকসম্পন্নগণ, তোমরা আমাকে ভয় করো।’ (সুরা বাকারা : ১৯৭)। আর হজ ও কোরবানি উভয়টাই একটা অপরটার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই কোরবানির ব্যাপারেও আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আমার কাছে ওদের গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় শুধু তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ : ৩৭)। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআন শরিফে মুত্তাকি ও আল্লাহর ওপর ভরসাকারীদের জন্য অগণিত রিজিকের সুসংবাদ দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেবেন এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দান করবেন, যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তার উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। তবে নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।’ (সুরা তালাক : ২-৩)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে এবং আনুগত্য করবে, আল্লাহ তার সব সংকট দূর করে দেবেন এবং তার কল্পনাতীত স্থান থেকে উত্তম রিজিকের সংস্থান করবেন। আর যে কেউ তার উদ্দেশ্য হাসিলে একমাত্র আল্লাহর শরণাপন্ন হবে, আল্লাহতায়ালা তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন। কোরআনের আলোকে এ কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেল, তাকওয়া অবলম্বনের মাধ্যমে আর্থিক স্বাবলম্বিতা ফিরে আসে। রিজিকের অভাব দূর হয়। কারণ, মুত্তাকি বান্দার উত্তম রিজিকের ব্যবস্থার দায়িত্ব খোদ আল্লাহতায়ালা নিজে গ্রহণ করেছেন। এ তাকওয়ার পরিচয় লাভ করার অন?্যতম মাধ্যম হলো, পবিত্র হজ পালন।

হজের ইস্তিগফারে রিজিক বাড়ে

অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার এবং বেশি বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেও রিজিক বৃদ্ধি পায়। আল্লাহতায়ালা তাঁর অন্যতম নবী ও রাসুল নুহ (আ.)-এর ঘটনা তুলে ধরে এরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও; নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল। (তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলে) তিনি তোমাদের ওপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, আর তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের জন্য বাগ-বাগিচা দেবেন আর দেবেন নদী-নালা।’ (সুরা নুহ : ১০-১২)। তওবা-ইস্তিগফারের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, নিজের ভবিষ্যতে সব পাপ না করার দৃঢ় ওয়াদা করে অতীতের সব গোনাহ মাফ করিয়ে নেয়া। আর এ বিষয়টি হাসিল হওয়ার সর্বোত্তম মাধ্যম হচ্ছে, পবিত্র হজ ও ওমরা পালন। নির্ধারিত কয়েকদিন সুনির্দিষ্ট কিছু কাজ সম্পাদন করেই জান্নাতে যাওয়ার ইবাদত হজ। হাদিসে একাধিক বর্ণনায় এসেছে, যাবতীয় পাপ থেকে নিষ্পাপ শিশুর মতো হওয়ার মাধ্যমও হজ। হাদিস শরিফে বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করে বলা হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তিগফার করবে, আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের সংস্থান করে দেবেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৫২০, সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৮১৯, তাবারানি : ৬২৯১)। অন্য হাদিসে সহিহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তিগফার করবে, আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ (সুনানে বাইহাকি : ৬৩৬, মুস্তাদরাকে হাকেম : ৭৬৭৭)। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘তোমরা হজ ও ওমরার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখ। কারণ, এ দুটি দারিদ্রতা এবং গোনাহ উভয়টি দূর করে দেয়; যেমন হাপর লোহা ও সোনা-রুপার ময়লা দূর করে। আর মাবরুর হজের প্রতিদান জান্নাত বৈ কিছুই নয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ৪৪৬২)।

হজে শোকরিয়া আদায়ে ধন বাড়ে

সাধারণভাবে আল্লাহ যে রিজিক ও নেয়ামতরাজি দান করেছেন, তার জন্য আল্লাহর শোকরিয়া করা এবং তাঁর স্তুতি গাওয়া চাই। কারণ, শোকরিয়ার ফলে নেয়ামত বৃদ্ধি পায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, যদি তোমরা শোকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের নেয়ামত বাড়িয়ে দেব; আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আজাব বড় কঠিন।’ (সুরা ইবরাহিম : ৭)। আয়াতে আল্লাহতায়ালা শোকরিয়ার বদৌলতে নেয়ামত বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। আর হজের তওয়াফের মধ্যে যে তালবিয়া পাঠ করা হয়, লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক- এ দোয়াটির প্রায় প্রত্যেকটি শব্দই আল্লাহতায়ালার হামদ বা শোকরিয়ামূলক অর্থ ও মর্মে পরিপূর্ণ। তাই এ আশা-সম্ভাবনাও প্রবল যে, হজের মাধ?্যমে কখনও অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধি বৈ কমবে না।

হজে প্রার্থনায় প্রাচুর্য লাভ হয়

অভাবের সময় আল্লাহমুখী হওয়া এবং তাঁর কাছে দোয়া করতে হয়। রিজিক অর্জনে এবং অভাব দূরীকরণে প্রয়োজন আল্লাহর কাছে দোয়া করা। কারণ, তিনি প্রার্থনা কবুল করেন। আর আল্লাহতায়ালাই রিজিকদাতা এবং তিনি অসীম ক্ষমতাবান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’ (সুরা মোমিন : ৬০)। এ আয়াতে আল্লাহ দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন; তিনি তা কবুলের জিম্মাদারি নিয়েছেন, যাবৎ না তা কবুলের পথে কোনো অন্তরায় হয়। যেমন- ওয়াজিব তরক করা, হারাম কাজে জড়ানো, হারাম আহার গ্রহণ বা হারাম পরিচ্ছদ পরা ইত্যাদি এবং কবুলকে খানিক বিলম্বিতকরণ। আল্লাহর কাছে দোয়া বলা যেতে পারে, ‘হে রিজিকদাতা! আমাকে রিজিক দান করুন, আপনি সর্বোত্তম রিজিকদাতা। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে পবিত্র সুপ্রশস্ত রিজিক চাই। হে ওই সত্তা, দানের ঢল সত্ত্বেও যার ভাণ্ডারে কমতি হয় না! হে আল্লাহ, আমাকে আপনি আপনার হালাল দিয়ে আপনার হারাম থেকে যথেষ্ট করে দিন; আর আপনার দয়া দিয়ে আপনি ছাড়া অন্যদের থেকে যথেষ্ট হয়ে যান। হে আল্লাহ, আপনি আমাকে যে রিজিক দিয়েছেন, তা দিয়েই সন্তুষ্ট বানিয়ে দিন। আর যা আমাকে দিয়েছেন, তাতে বরকত দিন।’ অভাবকালে মানুষের কাছে হাত না পেতে আল্লাহর শরণাপন্ন হলে এবং তাঁর কাছেই প্রাচুর্য চাইলে অবশ্যই তার অভাব মোচন হবে এবং রিজিক বাড়ানো হবে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অভাবে পতিত হয়, এরপর তা সে মানুষের কাছে সোপর্দ করে (অভাব দূরীকরণে মানুষের ওপর নির্ভরশীল হয়), তার অভাব মোচন করা হয় না। পক্ষান্তরে যে অভাবে পতিত হয়ে এর প্রতিকারে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হয়, তবে অনিতবিলম্বে আল্লাহ তাকে তড়িৎ বা ধীর রিজিক দেবেন।’ (তিরমিজি : ২৮৯৬, মুসনাদে আহমদ : ৪২১৮)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত