নতুনের কথা শুনলেই মানুষের মন দোলা দিয়ে ওঠে। এক মোহ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিটি নতুনের খোঁজে। নতুনের প্রতি আকর্ষণ বস্তুত একটি প্রশংসনীয় প্রেরণা এবং মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। এ উদ্দীপনা না থাকলে মানুষ পাথরের যুগ থেকে এটমের যুগ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হতো না। উট ও গরুর গাড়ি থেকে উড়োজাহাজ পর্যন্ত, মাটির প্রদীপ বা মোমবাতির আলো থেকে এনার্জি লাইট পর্যন্ত উন্নতি করতে পারত না। উৎসাহ ও উদ্দীপনা মানুষকে নিম্ন থেকে ঊর্ধ্বে, ঊর্ধ্ব থেকে ঊর্ধ্বতরে পৌঁছে দেয়। এ সবই মানুষের বস্তুগত উন্নতি ও বৈজ্ঞানিক সাফল্য। একদিকে যেমন তারা গ্রহ-নক্ষত্রের নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে, অন্যদিকে সাগরের গভীর তলদেশে পৌঁছে অজানাকে জানার পয়গাম নিয়ে এসেছে। এ সবই মানুষের এ সহজাত প্রেরণারই পরিণতি যে, সে আধুনিক প্রিয় এবং উত্তম থেকে উত্তমতরের প্রতি আকর্ষিত।
ইসলাম নতুন ও আধুনিক
প্রকৃতির স্বভাবজাত ধর্ম ইসলাম নতুন ও আধুনিক হওয়ার কারণে কোনো বিষয়ের প্রতি কোনোরূপ বিধি-নিষেধ আরোপ করেনি; বরং সময়ে তাকে প্রশংসনীয় বলা হয়েছে এবং উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষত, কারিগরি শিল্প ও যুদ্ধের কলাকৌশল ইত্যাদি বিষয়ে নতুন নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করার বিষয়টি রাসুল (সা.) থেকেই প্রমাণিত। গজওয়ায়ে আহজাবের (খন্দকের যুদ্ধ) সময় সমগ্র আরবগোত্র সম্মিলিতভাবে এক জোটে মদিনা আক্রমণ করার পরিকল্পনা আটে। সালমান ফারসি (রা.) তাদের মোকাবিলা করার জন্য একটি নতুন কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দেন। যেটি আরবভূমিতে এর আগে কখনও ব্যবহৃত হয়নি। সেই কৌশলটি ছিল শহরের চারপাশে গভীর পরিখা খনন করা। রাসুল (সা.) এ পরামর্শটি গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করেন। তিনি নিজেও পরিখা খননের কাজে অংশগ্রহণ করেন। (আর রাহিকুল মাখতুম : ২৭৭)।
নববি যুগে আধুনিকতার ছোঁয়া
সালমান ফারসি (রা.)-এর পরামর্শক্রমেই রাসুল (সা.) তায়েফ যুদ্ধে নতুন যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করেন। কোনো কোনো বর্ণনা মতে, সেগুলো সালমান ফারসি (রা.) নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল, আধুনিক কালের আগ্নেয়াস্ত্র জাতীয় এবং অন্যটি ছিল ট্যাংক জাতীয়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/৩৪৮)। এক হাদিসে বর্ণিত আছে, ব্যবসায়িক উন্নতির জন্য রাসুল (সা.) কাপড়ের ব্যবসা করার জন্য মানুষকে উপদেশ দান করতেন। কেননা, কাপড় ব্যবসায়ীরা মনে মনে কামনা করে, মানুষ সুখী সচ্ছল থাকুক। (কানজুল উম্মাল : ২/১৯৭২)। এমনকি নবীজি (সা.) কিছু লোককে ব্যবসার উদ্দেশ্যে ওমান ও মিশরে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কৃষি ও খনিজ দ্রব্য থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য তিনি এরশাদ করেন, ‘জমিনের লুকায়িত নেয়ামতের মধ্যে তোমরা রিজিক অনুসন্ধান কর।’ (কানজুল উম্মাল : ২/১৯৭)।
নতুনত্বের ব্যাপারে ইসলাম
নিছক নতুন হওয়ার কারণে কোনো নতুন পদক্ষেপ বা আবিষ্কারের ওপর ইসলাম কোনো আপত্তি তোলেনি; বরং বৈধ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বৈধ সীমার মধ্যে থেকে আধুনিকতার প্রীতিকে উৎসাহিত করেছে। তবে এটাও বাস্তব সত্য যে, আধুনিকতা প্রীতি ও নতুনের প্রতি আকর্ষণ যেমনিভাবে মানুষকে বস্তুগত উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিয়েছে, নতুন নতুন আবিষ্কারের পথ উন্মুক্ত করেছে, ঠিক তেমনিভাবে এটা মানুষকে আক্রান্ত করেছে অসংখ্য আত্মিক ব্যাধিতে, ধ্বংসাত্মক ক্ষতি সাধন করেছে অনেক। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, আধুনিকতা প্রীতি এমন তরবারির ন্যায়, যার উভয় দিক ধারালো। যা একদিকে যেমন মানুষের অশেষ উপকার সাধন করতে পারে, অন্যদিকে সর্বনাশা ক্ষতিও ডেকে আনতে পারে। অতএব, একটি নতুন আবিষ্কার নিছক নতুন হওয়ার কারণে যেমন গ্রহণীয় হতে পারে না, আবার শুধু নতুন হওয়ার কারণে বর্জনীয় হতে পারে না।
শরিয়তসম্মত আধুনিকতার ভিত্তি
এর কি এমন কোনো মাপকাঠি আছে, যার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, কোন আবিষ্কারটি উপকারী ও সাদরে গ্রহণীয়; আর কোনটি ক্ষতিকারক ও পরিত্যাজ্য? এ মানদণ্ড নির্ধারণের দু’টি পদ্ধতি হতে পারে। একটি পদ্ধতি এটা হতে পারে, বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে বিবেক-বুদ্ধির ওপর সমর্পণ করা হবে। যেমনটা স্যেকুলার সমাজ বিবেক-বুদ্ধির কাছেই সিদ্ধান্তের ভার অর্পণ করেছে। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো, প্রগতিবাদের নামে যারা মনুষ্য সমাজ থেকে শিষ্টাচার এবং শালীনতার যাবতীয় গুণ ছিনিয়ে নিয়ে পশুত্ব ও হিংস্রতার অন্ধকারের গলিতে এনে দাঁড় করিয়েছে, তারা সবাই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দাবিদার ছিল। তাদের বিবেক-বুদ্ধি নিজেদের এবং সমাজকে নষ্ট ও ভ্রষ্ট করে ছেড়েছে। মোটকথা, যুগের নতুনত্ব সম্পর্কে ভালো-মন্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্যেকুলারদের চিন্তাজাত বুদ্ধি ও জ্ঞান সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।
আল্লাহপ্রদত্ত বিধান থেকে নির্দেশনা গ্রহণ
আধুনিকতার এ সমস্যা সমাধানের জন্য এখন একটিমাত্র পথ অবশিষ্ট রয়েছে। তা হলো, আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত বিধিবিধান থেকে দিকনির্দেশনা গ্রহণ করা। মানবতার মুক্তির জন্য এ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। কোরআনুল কারিমে এরশাদ হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত নিদর্শন অনুসরণ করে, সে কি তার মতো- যার কাছে তার মন্দ কর্মগুলো ভালো বলে মনে হয় এবং সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে!’ (সুরা মুহাম্মদ : ১৪)। সুতরাং এ সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো, যুগের প্রতিটি নতুন পন্থা, পদ্ধতি ও আবিষ্কার, প্রতিটি নতুন প্রথা ও প্রচলনকে তার বাহ্যিক চমকের ওপর ভিত্তি করে গ্রহণ করা চলবে না; বরং সেগুলোকে গ্রহণ করতে হবে এ ভিত্তিতে যে, তা সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ অনুযায়ী হচ্ছে কিনা! যদি সে ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশ থেকে থাকে, তাহলে তাকে দ্বিধাহীনভাবে মেনে নিতে হবে। আর যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশ না থাকে এবং শরিয়তের কোনো বিষয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, তাহলে সেটা মানা যাবে।
আধুনিকতার ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা
আধুনিকতার ব্যাপারে আরও একটি বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া দরকার- মানবজ্ঞান অতি ক্ষুদ্র। বাহ্যিক কিছু ফলাফলের ওপর এর গণ্ডি সীমাবদ্ধ। অভ্যন্তরীণ তথ্য ও নিগুঢ় রহস্য উদ্ঘাটনে এটা বড়ই ব্যর্থ। সুতরাং মানবজ্ঞানের মাধ্যমে এসব বিষয়ের হেদায়েত বা সঠিক সিদ্ধান্ত পর্যন্ত পৌঁছা অসম্ভব। তাই অহি ও আহকামে শরিয়ত তীব্র প্রয়োজন। এ কারণেই আল্লাহর বিধান অনুসরণ করাও একান্ত জরুরি। যুগের কোনো প্রথাকে প্রথমে নিজের জ্ঞান দ্বারা নির্ভুল এবং উত্তম বলে স্থির করে নিয়ে তারপর কোরআন-সুন্নাহকে তার সঙ্গে ফিট করার জন্য টানাটানি করা এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের চোরাপথ অবলম্বন করা মোটেও সমীচীন নয়। কেননা, একে আল্লাহর বিধান অনুসরণ করা বলা যায় না। এটাকে বরং অনুসরণের নামে উদ্ভট সংশোধন ও পরিবর্তন বলা যায়। এরশাদ হচ্ছে, ‘আপনার প্রতিপালকের বাণী যথার্থ সত্য ও ভারসাম্যপূর্ণ। তাঁর বাণীর কোনো পরিবর্তনকারী নেই। তিনি শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী। আর যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চলেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। তারা শুধু অলীক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ অনুমানভিত্তিক কথাবার্তা বলে। আপনার প্রতিপালক তাদের সম্পর্কে খুব জ্ঞাত রয়েছেন। যারা তাঁর পথ থেকে বিপথগামী এবং তিনি তাদেরও খুব ভালো করে জানেন, যারা তাঁর পথে অনুগমন করে।’ (সুরা আনআম : ১১৫-১১৭)। তবে এ বিধান যেসব বিষয়ে কোরআন-হাদিস ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব ও হারাম বা মাকরুহ করেছে, সেসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। সুতরাং এ বিধান সর্বযুগে সর্বাবস্থায় অপরিবর্তনীয় থাকবে। আর যে বিষয়গুলো মোবাহের অন্তর্ভুক্ত, সে বিষয়ে মানুষকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। মানুষ সময়ের দাবি ও প্রয়োজন অনুযায়ী সে ক্ষেত্রে গ্রহণ বা বর্জনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব
চিন্তা করলে দেখা যাবে, জীবনের এমন বিষয়ের সংখ্যা খুবই কম, যেখানে শরিয়ত কোনো একটা ধরা-বাঁধা গণ্ডির কথা সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছে; বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিষয়গুলোকে মোবাহের অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছে। তা গ্রহণ বা বর্জনের বিষয়টি সব সময় পরিবর্তনশীল। সুতরাং আজ মুসলিম বিশ্বের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো, প্রগতিবাদের বৈধ-অবৈধ সীমা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা; ইসলাম মানুষকে আধুনিকতা বিকাশের জন্য যে প্রশস্ত ক্ষেত্র দান করেছে, তা গ্রহণ করা; শরিয়তের বিধান যেসব বিষয়ের সীমানা নির্ধারণ করেছে এবং যেসব বিষয়ের অপরিবর্তনীয় বলে ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে অনধিকার চর্চা না করা।
লেখক : খতিব, কাজী ফিরোজ রশিদ জামে মসজিদ, ঘাঘরবাজার, কোটালিপাড়া, গোপালগঞ্জ