ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ব্যবসায়ীর প্রতি ইসলামের নির্দেশনা

রহমাতুল্লাহ বিন আবু বকর
ব্যবসায়ীর প্রতি ইসলামের নির্দেশনা

ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুসংহত নীতি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে কোরআন-সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কেরাম এবং পূর্বসূরীদের জীবনচরিত থেকে অনুসৃত গুণাগুণ, ব্যবহার ও শিষ্টাচার। প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে সে গুণাগুণ অনুসরণ করা আবশ্যক। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, আল্লাহতায়ালা ব্যবসায়ীকে ইনসাফ ও ইহসান উভয়টার নির্দেশ দিয়েছেন। ইনসাফ মুক্তিলাভের মাধ্যম। একজন ব্যবসায়ীর জন্য ইনসাফ হলো মূলধন। আর ইহসান হলো সফলতা ও সৌভাগ্যের মাধ্যম। ব্যবসার ক্ষেত্রে ইহসান হলো লাভের পর্যায়ে। দুনিয়ার ব্যবসায় যে ব্যক্তি লাভ না নিয়ে শুধু মূলধনের ওপরই রাজি থাকে, তাকে কেউই বুদ্ধিমান মনে করে না; তেমনি আখেরাতের সওদার ক্ষেত্রেও। সুতরাং দ্বীনদারদের জন্য ইহসান ছাড়া শুধু ইনসাফ ও জুলুম পরিহারের ওপর ক্ষ্যান্ত থাকা মোটেই সমীচীন নয়। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ যেমন তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তেমনি তুমিও অনুগ্রহ কর।’ (সুরা কাসাস : ৭৭)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সুরা নাহল : ৯০, এহইয়াউ উলুমিদ্দিন : ২/৮০)।

সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা ও কল্যাণকামিতা

এমনিভাবে সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা ও কল্যাণকামিতা ব্যবসায়ীর অন্যতম গুণ। হাদিসে এসেছে, আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘সত্যবাদী বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবীগণ, সিদ্দিক ও শহিদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি : ১২০৯)। রিফাআ (রা.) সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে ঈদগাহে বেরুলেন। নবীজি (সা.) লোকদের কেনাবেচা করতে দেখে তাদের সম্বোধন করে আওয়াজ দিলেন। তারা সবাই রাসুল (সা.)-এর ডাকে সাড়া দিয়ে তার প্রতি মনোযোগী হলো। তখন নবীজি (সা.) বললেন, ‘নিশ্চয় ব্যবসায়ীরা কেয়ামতের দিন পাপিষ্ঠ হিসেবে উঠবে। তবে তাদের মধ্য হতে যারা আল্লাহকে ভয় করে চলে এবং পুণ্যের কাজ করে ও সত্য কথা বলে, তারা নয়।’ (তিরমিজি : ১২১০)।

ব্যবসায় যা পরিহার করা আবশ্যক

আবার কিছু বিষয় এমন আছে, যেগুলো একজন ব্যবসায়ীর পরিহার করে চলা আবশ্যক। উদাহরণস্বরূপ- গবান তথা প্রতারণা। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, সাধারণ প্রচলনে যতটুকু কমবেশি করে কেনাবেচা করা হয়, এর চেয়ে খুব বেশি ব্যবধান করে চড়ামূল্যে কোনো ব্যবসায়ী বিক্রি করবে না। এটা প্রতারণা। তবে ব্যবসা যেহেতু লাভ করার জন্য, তাই সামান্য বেশি মূল্যে বিক্রি করা বৈধ। ক্রেতার কোনো পণ্যের প্রতি অধিক প্রয়োজনের কারণে বা পছন্দ হওয়ার কারণে যদি সে পণ্যটি চড়ামূল্যে ক্রয় করতেও রাজি হয়, তবুও বিক্রেতা অতিরিক্ত লভাংশ গ্রহণ করবে না। কেননা, এটাই ইহসান; যদিও ধোঁকা না দিয়ে অধিক লভাংশ গ্রহণ করা জুলুম নয়। কোনো কোনো আলেম তো পণ্যের মূল্যের এক-তৃতীয়াংশের বেশি লাভে বিক্রি করলে ক্রেতার উক্ত পণ্য ফিরিয়ে দেয়ার অধিকার থাকবে মর্মে মত পেশ করেছেন। এ মতটি যদিও গ্রহণযোগ্য নয়, তবে ওই গৃহীত অতিরিক্ত লাভ ফিরিয়ে দেয়া ইহসানের দাবি।

ইহসানের একটি দৃষ্টান্তমূলক গল্প

ইউনুস ইবনে ওবাইদ নামক এক বুজুর্গ কাপড় ব্যবসায়ীর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, তার কাছে বিভিন্ন মূল্যের পোশাক ছিল। কোনোটার মূল্য নির্ধারণ করেছিলেন চারশত মুদ্রা, আবার কোনোটার দু’শত মুদ্রা। একদিন তার এক ভাতিজাকে দোকানে রেখে তিনি নামাজে গেলেন। তখন এক গ্রাম্য ক্রেতা এসে চারশত মুদ্রার বিনিময়ে একটি পোশাক চাইল। ভাতিজা লোকটির হাতে দু’শত টাকার একটি পোশাক দিলো। পোশাকটি তার পছন্দ হলো। তাই সে চারশত টাকা দিয়ে সেটি কিনে নিয়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে (মূল মালিক) ইউসুফের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। লোকটির হাতে থাকা কাপড়টি তিনি চিনতে পারলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত দিয়ে কিনলেন।’ লোকটি বলল, ‘চারশত মুদ্রায়।’ ইউনুস বললেন, ‘না, এর মূল্য তো দু’শতের বেশি হবে না। আমার সঙ্গে চলুন, অতিরিক্তটা ফেরত পাবেন।’ লোকটি বলল, ‘কী বলেন! আমাদের এলাকায় তো এর মূল্য পাঁচশত মুদ্রা। তা ছাড়া আমি তো খুশিমনেই কিনেছি।’ তখন ইউনুস বললেন, ‘চলুন না। দুনিয়ার তুলনায় দ্বীনের ক্ষেত্রেই কল্যাণকামিতা উত্তম।’ একপর্যায়ে তাকে দোকানে ফিরিয়ে এনে দু’শত মুদ্রা ফিরিয়ে দিলেন। এরপর ভাতিজার সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হলেন, ‘তোমার কী একটু লজ্জা হলো না! তুমি কি আল্লাহকে একটু ভয় করলে না! তুমি মুসলমানের কল্যাণ কামনা না করে মূল্য সমপরিমাণ লাভ গ্রহণ করলে!’ ভাতিজা ওজর পেশ করে বলল, ‘চাচাজান! আল্লাহর শপথ, তিনি দেখে-শুনে খুশিমনেই কিনেছেন।’ তিনি বললেন, ‘বুঝলাম। তারপরও তুমি নিজের ব্যাপারে যা পছন্দ কর, লোকটির ব্যাপারে তা পছন্দ করলে না কেন?’ পণ্যের মূল্য গোপন না করে ধোঁকার আশ্রয় না নিয়ে এমন চড়ামূল্যে বিক্রি করা জুলুম না হলেও ইহসানের তো অবশ্যই বিপরীত। আর সাধারণত প্রতারণার আশ্রয় না নিয়ে এত চড়ামূল্যে বিক্রি করা সম্ভব হয় না।

ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের পক্ষ থেকে ইহসান

সুররি আস সিকতি নামক এক সৎ ব্যবসায়ীর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, তিনি ষাট দিনার দিয়ে ব্যবসার উদ্দেশে কিছু পরিমাণ আখরোট কিনলেন। রেজিস্টার খাতায় লিখলেন, এই আখরোটে তিন দিনার লাভ করব। অর্থাৎ তিনি শতকরা ২০ শতাংশ লাভ গ্রহণ করতেন। এদিকে হঠাৎ সেই আখরোটের দাম বৃদ্ধি পেয়ে নব্বই দিনার হলো। এরপর এক লোক তার থেকে আখরোট কিনতে এলো। তিনি আখরোট দেখালেন। মূল্য জানতে চাইলে বললেন, ‘তেষট্টি দিনার।’ ক্রেতাও ছিলো অতুলনীয় সততার অধিকারী। সে বলল, ‘আখরোটের দাম বেড়েছে পেয়েছে। এগুলোর মূল্য তো নব্বই দিনারের কম হবে না।’ তিনি বললেন, ‘আমি প্রতিজ্ঞা করে আছি যে, আমি তা ভক্ষণ করতে চাই না। এই আখরোট আমি তেষট্টি দিনারেই বিক্রি করব।’ ক্রেতা বলল, ‘আমিও আল্লাহতায়ালার সঙ্গে একটি চুক্তি করে রেখেছি যে, আমি কোনো মুসলমানকে ধোঁকা দেব না। আমি আপনার থেকে নব্বই দিনারের কমে কিনব না।’ ফলে তাদের মাঝে আর কেনাবেচা হলো না।

মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির (রহ.)-এর গল্প

বিক্রির জন্য তার কাছে কিছু কাপড় ছিল। কোনোটার দাম ছিল পাঁচ মুদ্রা, আর কোনোটার দাম ছিল দশ মুদ্রা। একদিন তার অনুপস্থিতিতে তার গোলাম পাঁচ মুদ্রার একটি কাপড় দশ মুদ্রায় বিক্রি করে দিল। তিনি এ কথা জানতে পেয়ে ক্রেতার খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। সারাদিন খোঁজাখুঁজি করে দিন শেষে সেই ক্রেতাকে পেলেন। তিনি তাকে বললেন, ‘আমার গোলাম ভুলে পাঁচ মুদ্রার কাপড় আপনার কাছে দশ মুদ্রায় বিক্রি করেছে।’ ক্রেতা বলল, ‘সমস্যা নেই, আমি দশ মুদ্রায়ই কিনতে রাজি।’ মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির (রহ.) বললেন, ‘আপনি রাজি হলেও আমি তো নিজের বেলায় যাতে রাজি হতাম, আপনার বেলায়ও তাতেই রাজি হব। সুতরাং আপনি তিনটি প্রস্তাবের কোনো একটি বেছে নিন- ক. আপনার প্রদেয় মুদ্রাগুলোর বিনিময়ে আপনি ১০ মুদ্রার একটি কাপড় গ্রহণ করবেন। খ. আপনি পাঁচ মুদ্রা ফেরত গ্রহণ করবেন। গ. কাপড়টি ফেরত দিয়ে আপনার প্রদেয় দিরহামগুলো নিয়ে নেবেন।’ সে বলল, ‘আমাকে পাঁচ দিরহাম ফেরত দিন।’ ক্রেতা ফিরে যাওয়ার সময় লোকদের জিজ্ঞেস করল, ‘এই বুজুর্গ লোকটি কে?’ জানতে পারল, তিনি হলেনে মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির। সে মুগ্ধ হয়ে বলল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আমরা যদি কখনও অনাবৃষ্টিতে ভুগি, তাহলে আল্লাহতায়ালার কাছে এই লোকের মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করব।’ এটা হলো ইহসানের দৃষ্টান্ত। স্বাভাবিকভাবে যে ব্যক্তি অল্প লাভে বিক্রি করবে, তার বিক্রি বেশি হবে। ফলে সে বেশি লাভবান হবে। এর দ্বারাই ব্যবসায় অনাবিল বরকত লাভ হয়।

লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, আল জামিআতুল ইসলামিয়া ইসলামপুর

(ভবানিপুর মাদ্রাসা), গোপালগঞ্জ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত